শিক্ষকতা পেশায় কতটা নিরাপদ নারীরা
জাতির মেরুদণ্ড গঠনের ভার যাদের ওপর, তারা হলেন শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। কারণ তাদের হাত ধরেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সামনের দিকে এগিয়ে চলে। কিন্তু যারা সমাজ গঠনের নেপথ্যে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, সেই শিক্ষকদের অবস্থান নিয়ে জাতি আজ শঙ্কিত!তারও বেশি উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় নারী শিক্ষকদের।
শিক্ষককে একসময় সবচেয়ে সম্মানিত আসনটি দেওয়া হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় পরিবর্তন এসেছে। সমাজের আর দশটা করপোরেট সেক্টর থেকে শিক্ষকতার জায়গায়টাও নির্ভেজাল নয়! করপোরেট জগতে নারীদের টিকে থাকতে দিনের পর দিন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তেমনই নারীদের জন্য পেশা হিসেবে শিক্ষকতায় রয়েছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।
পেশাগত জীবনে নারীরা সবসময় নিরাপদ নয়। কর্মক্ষেত্রে সবসময় সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশ তারা পান না। সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, নারীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর পরিবেশ, সময়ানুযায়ী, ঘরোয়া চাকরি হিসেবে ধরে নেওয়া হয় শিক্ষকতা। সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি একটি নিশ্চিত চাকরি শিক্ষকতা। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পরিবারের জন্য অনেকটা সময় বের করতে পারেন। এমন কিছু সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র করে একজন নারী শিক্ষকতাকে নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় নারীরা কতটা নিরাপদ?
সামজিক নানা অবক্ষয়ের মুখে পতিত শিক্ষাকতা পেশাও। যে পেশা মানুষ গড়ার কারিগর, সেখানেও নারী-পুরুষ বৈষম্য রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু সরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের কিঞ্চিৎ সুবিধা রক্ষিত হলেও বেসরকারি পর্যায়ে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন! পুরুষ শিক্ষকের তুলনায় বেশি দায়িত্ব পালন করা তো নারী শিক্ষকদের জন্য নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এছাড়া কোনো পুরুষ শিক্ষকের জরুরি কাজ, ছুটিতে থাকা বিভিন্ন রকম অজুহাতে ভরসা নারী শিক্ষকেরা।
নারী শিক্ষকদের শুধু এমন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েই কর্তৃপক্ষ শান্তিতে থাকে না! বেসরকারি পর্যায়ে বেশ সার্কাস জমে ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! সব প্রতিষ্ঠান এক নিয়মে চলে এমন নয়। তবে, শহরের আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে চলছে রমরমা ব্যাবসাও। সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকায় বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে কর্তৃপক্ষের পছন্দ অনুযায়ী! নামমাত্র বেতনে বা দীর্ঘদিন খণ্ডকালীন শিক্ষক রেখে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে শিক্ষা প্রদান! এই চিত্র স্কুল থেকে শুরু করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লক্ষ করা যায়।
সরকারি,-বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাখাতে নারীদের জন্য নতুনভাবে ভাবতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমিটি গঠন করতে হবে। নারী শিক্ষকদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ গঠন করতে হবে। শিক্ষকেরা নিরাপদ জীবন পরিচালনা করলে তবেই শিক্ষার্থীদের জীবনও নিরাপদভাবে গড়ে উঠবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও একধাপ এগিয়ে। এখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক কোন বিধান না থাকায় এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ায় প্রতিষ্ঠানে চলে মাৎস্যন্যায়। এর নেপথ্যে রয়েছে কর্তৃপক্ষের অসৎ উদ্দেশ্য! অসৎ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন খণ্ডকালীন রেখে তার সামনে একটা মুলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যেন অন্যায়-অবিচার হলেও মুখ খুলতে না পারেন নারী শিক্ষকরা। হরহামেশাই নারী শিক্ষকেরা নানারকম নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন আজকাল। গণমাধ্যম বরাতে এমন দৃশ্যও আমাদের সামনে উঠে এসেছে। যেখানে নারী শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বোসা করানো হয়েছে, যৌন হয়রানির মতো একাধিক ঘটনা ঘটেই চলেছে!
সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো মনিটরিং কমিটি নেই। যার ফলে নারীরা কর্তৃপক্ষ, বিভাগীয় শিক্ষকদের দ্বারা অসদাচরণের শিকার হলে যেখানে তার সুবিচার পান না। পুলিশ প্রশাসনের শরণাপন্ন না হয়ে যদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্দিষ্ট কমিটি থাকলে তবে প্রাথমিক পর্যায়ের সমস্যাগুলো তারা সহজেই সমাধান করতে পারেন।
নারীদের ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশা বর্তমানে চরম ফাঁদ! নারীরা পূর্বে যেমন বাছবিচারহীনভাবেই শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলে গ্রহণ করতে পারতো, এখন ঠিক ততটা সুস্থ পরিবেশ নারীদের জন্য নেই। এর কারণ মানুষের মাঝে চরম অবক্ষয়। বিবেক, নীতিবোধ, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব নিয়ে আজ মানুষ শঙ্কিত নয়৷ ফলে এই চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে সব জায়গায়। যার ছাপ এড়াতে পারেনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। নৈতিকতার অভাবে পুরুষ শিক্ষক, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হন বহু নারী শিক্ষক। কিন্তু মান-মর্যাদার কারণে প্রতিবাদ করে উঠতে পারেন না। আজকের শিক্ষাব্যবস্থা সবদিক থেকেই বেশ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে এ কারণেই।
নারী সহকর্মীর প্রতি আচরণ কেমন হওয়া উচিত, বেশিরভাগ শিক্ষক এই বিষয়ে উদাসীন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নারীরা নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নারীরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে এই মহান পেশাকে অতিবাহিত করতে পারছেন না। এর দায় কর্তৃপক্ষের যতটা ঠিক, ততটা দায় রাষ্ট্রেরও। কারণ রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করা উচিত কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি কেমন আচরণ করা হবে। নারীরা সমস্যার সম্মুখীন হলে তার আশু নিষ্পত্তি কিভাবে সম্ভব, তারও ব্যবস্থা করা। সরকারি,-বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাখাতে নারীদের জন্য নতুনভাবে ভাবতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমিটি গঠন করতে হবে। নারী শিক্ষকদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশ গঠন করতে হবে। শিক্ষকেরা নিরাপদ জীবন পরিচালনা করলে তবেই শিক্ষার্থীদের জীবনও নিরাপদভাবে গড়ে উঠবে।