নারীর জন্য ৯টি সিট, বাকিগুলো পুরুষের?
ঢাকা শহরে সাধারণ মানুষের জন্য প্রতিটি আনাচে-কানাচে দুর্ভোগ। নারীর জন্য দুর্ভোগের পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষ একটু বেশিই হয়। এই যেমন পাবলিক বাস, যারা নিয়মিত বাসে চলাফেরা করে, তাদের জন্য এক হয়রানির নাম পাবলিক বাস। তবে নারীর জন্য শুধু হয়রানি নয় আতঙ্কের নামও পাবলিক বাস। নারীদের হেনস্তা, নির্যাতন, হয়রানি এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনা অহরহ ঘটতে দেখা যায়। তবে এর বাইরে আরও একটি বিষয় নিয়ে নারীদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় তা হলো ‘সংরক্ষিত ৯ টি আসন’।
একটি বাসে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টি সিট তো আছেই। তার মধ্যে প্রথম নয়টি সিট নাকি বরাদ্দ নারীদের জন্য। যাকে বলা হচ্ছে ‘মহিলা সিট’। কিন্তু নারীর সঙ্গে আরও দুইটি শব্দ যোগ করা আছে, ‘শিশু ও প্রতিবন্ধী।’ তাহলে ‘মহিলা সিট’ বলে ওই ৯টি সিটকে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর নাহয় পরে খুঁজি। এবার চলুন এই ‘মহিলা সিট’ বিষয়টি নিয়ে নারীদের ঠিক কী কী হয়রানি সহ্য করতে হয়, সেই প্রসঙ্গে।
আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা এতটা শেকল গেঁড়ে বসে আছে যে, একে সমূলে উৎপাটন তো দূরের কথা, এর মূল কতটা বিস্তৃত তা খুঁজে পাওয়াই দায়। একটি পাবলিক বাসে বিভিন্ন লিঙ্গের, বয়সের, পেশার মানুষ যাতায়াত করে। আর ঢাকা শহরের পাবলিক বাসের চিত্র সবারই মোটামুটি পরিচিত। হুমড়ি খেয়ে বাসে একফোঁটা জায়গা পাওয়ার জন্য দৌড়াতে হয়, সেখানে সিট খুঁজে পাওয়া তো বিলাশবহুল ব্যাপার। এবার বাসের সেই ভোগান্তির মধ্যে একদল পুরুষ আক্ষেপ প্রকাশ করেন সংরক্ষিত সেই নয়টি সিট নিয়ে। কেউ কেউ আবার নারীদের হয়রানিমূলক কথাও শোনান এই নয়টি সিট নিয়ে।
তবে সবচেয়ে প্রচলিত একটি ধারণা তাদের মধ্যে আছে যে, শুধু ওই ৯ টি সিটই নারীর। বাকিগুলোর পুরুষের বসার জন্য সংরক্ষিত। বহুবার দেখেছি যখন কোনো নারী যাত্রী সংরক্ষিত আসনে বসা পুরুষ যাত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেন এটা নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন, তখনই আক্রমণাত্মকভাবে পুরুষ যাত্রী বলে ওঠেন, ‘পুরুষের সিটে মহিলা বসে আছেন কেন!’ অনেক নারীকেই এই প্রশ্নের পর চুপ হয়ে যেতে দেখেছি। তারাও মেনে নিয়েছেন এই ৯টি ছাড়া বাকিসব পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত আসন।
পাবলিক বাসে নারীদের বিভিন্ন ধরণের হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। অন্যসব হয়রানির পাশাপাশি এই নয়টি সিট নিয়ে যে নারীদের কি হয়রানির শিকার হতে হয় তা খুব একটা কারো চোখে পড়ে না। এই সংরক্ষিত আসন বিন্যাসের নিয়মে মস্তবড় ভুল রয়েছে। নামে মাত্র নারীকে কয়েকটি আসন দেওয়া হলো; আবার সেই সঙ্গে পুরুষকে দেওয়া হলো, এই বিষয়ে নারীকে কথা শোনানোর ফ্রি টিকেট।
বাসে হালকা ভিড় শুরু হলেই ভেতরের যাত্রীরা বলে দেন, আর মহিলা তুলবেন না। সে মোতাবেক হেল্পারও চিৎকার করে ঘোষণা করেন কোনো মহিলা তোলা হবে না। যদিও প্রায় সময়ই বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সংরক্ষিত নারী আসনে কেবল ২/৩ জন নারী বসে আছেন বাকি সবাই পুরুষ যাত্রী।
কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব জায়গায় নারীদের প্রায় সমান সমান উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অফিস শেষে বাসের দরজায় ঝুলে নারীকেও ঘরে ফিরতে দেখা যায়। বাসে ৫০ জন যাত্রী থাকলে তার মধ্যে ২০ -২৫ জন নারীও চোখে পড়ে। তাহলে নারীর জন্য ৯টি সিট কেন, তাও আবার সঙ্গে শিশু ও প্রতিবন্ধী। নারীকে তাহলে কোন স্কেলে মাপা হলো এবং কতটুকু জায়গার যোগ্য বলে মনে করা হলো? যদি আমি তাদের ব্যবহৃত তিনটি শব্দ ধরি, ‘শিশু’, ‘নারী’, ‘প্রতিবন্ধী’র জন্য সংরক্ষিত আসন কেন সামনের ইঞ্জিনের গরম অংশটুকু। আবার যেসব বাসে ইঞ্জিনের অংশটুকুতে বসার অবস্থা নেই সেসব বাসে ‘সামনের ৯ টি আসন নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীদের’ নোটিশ থাকলেও তার তোয়াক্কা কেউ করেন না।
বাসে হালকা ভিড় শুরু হলেই ভেতরের যাত্রীরা বলে দেন, আর মহিলা তুলবেন না। সে মোতাবেক হেল্পারও চিৎকার করে ঘোষণা করেন কোনো মহিলা তোলা হবেনা। যদিও প্রায় সময়ই বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় সংরক্ষিত নারী আসনে কেবল ২/৩ জন নারী বসে আছেন বাকি সবাই পুরুষ যাত্রী।
যেই নয়টি আসনকে নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দেয়া হয়েছে কিংবা নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছে সেই আসনই আবার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর জন্য। নারীর দাঁড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, দাঁড়িয়ে থাকাই যৌন হয়রানির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় নারীর জন্য।
যদি কোনো নারী হেল্পার এর বাঁধা অমান্য করে উঠে যান। বাসের মধ্যে সুযোগসন্ধানী কয়েকজন পুরুষযাত্রী ঐ নারীকে হয়রানি করা শুরু করেন। তখন নারীদের চুপ করে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। প্রতিবাদ করলে বাসের প্রায় ৯০% শতাংশ পুরুষ যাত্রী একজোট হয়ে সেই নারীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, হেল্পার এর নিষেধ সত্ত্বেও কেন বাসে উঠলেন তিনি। হেল্পার আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘এজন্যই মহিলাদের বাসে তুলিনা’। সংরক্ষিত ৯ আসনে পুরুষ সদস্যরা বসে মুচকি হেসে নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সমান অধিকার তো, দাঁড়িয়ে যান।’
মোদ্দাকথা দাঁড়ালো গণপরিবহন ব্যবহারে নারীর না আছে সাচ্ছন্দ্য, না আছে নিরাপত্তা। যেই নয়টি আসনকে নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য দেয়া হয়েছে কিংবা নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছে সেই আসনই আবার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর জন্য। নারীর দাঁড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু, দাঁড়িয়ে থাকাই যৌন হয়রানির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় নারীর জন্য। হয় নারীর জন্য বাসে যেখানেই নারী দাঁড়িয়ে থাক, বসে থাক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, নয়তো নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন হওয়া দরকার পুরো একটি সারি। প্রতিবন্ধী ও শিশুদের সঙ্গে নারীকে নয়টি আসন দিয়ে নারীকে কোনো স্বাচ্ছন্দ্য দেয়া হয়নি বরং তাকে করা হয়েছে উপহাসের পাত্র, সহ্য করতে হচ্ছে নিয়মিত কটাক্ষ। ঐ যে একটা প্রবাদ আছে না, ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি!’