ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ
নারী শিক্ষা এককালে ছিল কেবল স্বপ্ন। নারীরাও পুরুষদের পাশাপাশি সমানতালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করবে, এ বিষয়ে সমাজের ছিলো বেশ কার্পণ্য। তবে নারীদের কাছে উচ্চশিক্ষা আজকাল আর স্বপ্ন নয়। তালে তাল মিলিয়ে নারীও বিশ্বজয় করছে। তবে এ যাত্রা শুরু হয়েছিল যেই নারীদের হাত ধরে তারা আজও স্মরণীয়। যেমন একজন লীলা নাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন তিনি। নারীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন তিনি।
তিনি বাঙালি সাংবাদিক, জনহিতৈষী ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। আজকের দিনে অর্থাৎ ২ অক্টোবর লীলা নাগ আসামের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ অবসর প্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মাতা ছিলেন কুঞ্জলতা দেবী চৌধুরী। তার পিতৃ-পরিবার ছিল তৎকালীন সিলেটের অন্যতম সংস্কৃতমনা ও শিক্ষিত একটি পরিবার। লীলা নাগ ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মে বিপ্লবী অনিল রায়কে বিবাহ করেন। আর তারপর থেকে লীলা নাগ লীলা রায় হিসেবেও পরিচিত হতে থাকেন।
তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকার ইডেন স্কুলে। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পদ্মাবতী স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এমএ ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রীধারী। তখনকার পরিবেশে সহশিক্ষার কোনও ব্যবস্থা ছিল না বলে লীলা রায়ের মেধা ও আকাঙ্ক্ষা বিচার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর ড. হার্টস তাকে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান করেন।
লীলা নাগ ঢাকা কলেজে পড়তেন। তার এক ক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, “এর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই।” বাঙালি নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তিনি বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলানগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (তৎকালীন নারীশিক্ষা মন্দির) প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত বিভাগের পর লীলা নাগ কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
লীলা নাগ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেত্রী ছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ‘দীপালী ছাত্রী সংঘ’ নামে ছাত্রী সংগঠন গড়ে ভারতে প্রথম তার মাধ্যমে ছাত্রীদের মধ্যে রাজনীতি চর্চা শুরু করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মহিলাদের আবাস ‘ছাত্রীভবন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের সময় তার উপর নারী আন্দোলনের ইতিহাস রচনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ফরোয়ার্ড ব্লক গঠিত হলে তিনি এই সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে কারারুদ্ধ হন। কারামুক্তির পর সুভাষচন্দ্রের নির্দেশে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিকের সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে নেতাজীর অন্তর্ধানের পর তিনি ও তার স্বামী অনিল রায় উত্তর ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠনের দায়িত্ব নেন। তিনি মহিলা সমাজের মুখপত্র হিসেবে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে “জয়শ্রী” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন।
১৯৭০ সালের ১১ জুন ভারতে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে। বাঙালি নারীদের অন্ধকার জীবনে শিক্ষার শিক্ষার মশাল নিয়ে যেকজন নারী এগিয়ে এসেছেন তার মধ্যে লীলা নাগ অন্যতম। আজও তার খুলে দেয়া রাস্তা দিয়ে নারীরা এগিয়ে চলছে এবং একের পর এক মাইলফলক স্পর্শ করছে। নারীর পথচলায় লীলা নাগের নাম আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।