Skip to content

৬ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রবীণ নারীদের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে হবে

সৃষ্টির নিয়মে মানুষকে বয়স অনুযায়ী জীবনে পাঁচটি স্তর বা ধাপ পার করতে হয়। স্তরগুলো হলো, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য। মানুষের জীবনের এই পাঁচটি স্তরের মধ্যে সবচেয়ে ভঙ্গুর, করুণ ও দুঃসহ জীবন বার্ধক্যকালীন সময়। যাকে অভিহিত করা হচ্ছে প্রবীণ রূপে। আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়। আর প্রবীণদের প্রতি সচেতন হওয়া, সহানুভূতিশীল হওয়া আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

প্রবীণরা দেশের বোঝা নয় বরং সম্পদ কারণ তাদের দীর্ঘ যাত্রার ফলেই তরুণ-যুবা সুদিন ভোগ করে। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসুন্ধরাকে বাসযোগ্য করে তোলার কাজটা তারাই করেন। ফলে প্রবীণদের প্রতি জাতির অনেক দায়। সে লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৯৯১ সাল থেকেই আজকের দিনটি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রবীণ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। কিন্তু একটি দিনকে ঘিরে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা বা তাদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিলেই বর্তমান সমস্যার সমাধান আসবে না। কারণ জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

তাই বেশিরভাগ পরিবারেই সঠিকভাবে প্রবীণরা তার সঠিক ও যোগ্য সম্মানটা পাচ্ছেন না। প্রবীণ নারীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে কর্মঅক্ষমতার ফলে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হয়ে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। জনসংখ্যার গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে যেমন প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। মূলত বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে যে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে সে বিষয় নিয়ে বলতে গেলে করোনাকালীন সময়টাকে বিশেষভাবে সামনে আনতে হবে। সেসময় পরিবারের প্রবীণ সদস্যটির সঙ্গে ঘটে চলা চরম অন্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জাতি হিসেবে বর্তমানে আমরা কতটা অসহিষ্ণু, নিপীড়নদায়ক! করোনার পরিস্থিতিই যে শুধু এমন দৃশ্যকে সামনে এনেছে এমন নয় বরং দেশের যততত্র গড়ে ওঠা বৃদ্ধাশ্রমগুলোও কিন্তু প্রবীণদের প্রতি অসদাচরণের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আমাদের সমাজে প্রবীণরা যে সমস্যাগুলোর মধ্যে দিয়ে বাকি জীবনটা পার করেন সেগুলো একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে খুবই দুঃসহ। সাধারণত যেসব সমস্যা তাদের মোকাবেলা করতে হয় তার মধ্যে রয়েছে:

১. পারিবারের বিরূপ আচরণ এবং বিচ্ছিন্নতা
২. কর্মঅক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা
৩. বার্ধক্যজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক নানা
জটিলতা
৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে অগ্রহণযোগ্যতা
৫. একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বর্তমানে পরিবারগুলো যৌথ থেকে একক পরিবারে রূপ নিয়েছে। ফলে সংসারের সদস্য সংখ্যাও তেমনই অনেকটা হাতে গোনা। স্বামী-স্ত্রী, সন্তানাদি নিয়েই বেশির ভাগ পরিবার। সেখানে পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা যেন বাড়তি বোঝা! ফলে তাদের প্রতি পরিবারের সদস্যদের দিক থেকে অনেকটা গা ছাড়া ভাব পরিলক্ষিত হয়। নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি যেমন পাল্টেছে তেমনই পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে শুরু হয়েছে বিরূপ আচরণ! পরিবারে যদি বয়স্ক সদস্য থাকে তিনি হয়ে পড়ছেন কোনঠাসা। তার মতামতের গুরুত্বও পাচ্ছে না পরিবারগুলোতে। ফলে পরিবার থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন প্রবীণরা। যুগের পরিবর্তনে জীবনাচরণও পাল্টেছে। অনেক সময় প্রবীণরা সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। যার দরুণ পরিবারে সংকীর্ণ একটা স্থান পেলেও সেখানেও তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হচ্ছে। জীবনের তাড়নায় মানুষ এখন বহির্মুখী। ফলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করা বা আনন্দময় মুহূর্তে দিন কাটনোর ব্যাপারেও এসেছে শিথিলতা। তাই বেশিরভাগ পরিবারেই সঠিকভাবে প্রবীণরা তার সঠিক ও যোগ্য সম্মানটা পাচ্ছেন না। প্রবীণ নারীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে কর্মঅক্ষমতার ফলে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হয়ে।

প্রবীণ নারীদের শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থ রাখার অন্যতম উপায় পরিবারের সদস্যদের পূর্ণ সহোযোগিতা। সরকারি ভাতা, সুযোগ -সুবিধার পাশাপাশি পরিবারকে প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে তাদের প্রতি দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের।

কারণ ৬০ বছর পর বাংলাদেশের বেশিরভাগ নাগরিকই অবসর জীবন পালন করেন। এক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও করুণ। নারীদের একটা বৃহৎ অংশই গৃহপরিচালনার মধ্য দিয়ে জীবন পার করে দেন। তাদের জন্য প্রবীণ বয়সে আরও দুঃসহ সময় দেখা দেয়। আবার অনেক নারীর স্বামীর মৃত্যুর ফলে নিজের শেষ সম্বল যতটুকু থাকে সেগুলোও সন্তানেরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। বৃদ্ধ মায়ের প্রতি সন্তানেরা তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। এই হতভাগ্য প্রবীণরা তাদের শারীরিক ত্রুটি, ইচ্ছে অনুযায়ী খাবার গ্রহণ বা ঘুরে বেড়াবার জন্য যতটুকু অর্থ দরকার তার সঠিক যোগান পান না। বেশিরভাগের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিলেও সঠিক চিকিৎসাও জোটে না! এক্ষেত্রে প্রবীণদের সঙ্গে ঘটে প্রহসন!
আজীবন পরিশ্রম করে যা সঞ্চয় করেন তা সন্তানদের মঙ্গল কামনায় তাদের জন্য সবটা উজাড় করে দিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে যখন তার বৃদ্ধকাল আসে তারা হয়ে পড়েন ওই পরিবারে সন্তানদের বোঝা!

বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। এসময় স্বাস্থ্যহানি এবং শারীরিক নানা জটিলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু প্রবীণদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করতে হয়। পরিবারের পক্ষ থেকেও প্রবীণদের প্রতি আগ্রহ বা উৎসাহ দেখা যায় খুব কম। এ সময় মানুষের একটু বিশ্রাম ও আরামের প্রয়োজন কিন্তু আমাদের দেশের প্রবীণদের ভাগ্যে সেটুকুও জোটে না। পারিবারিক নানা জটিলতায় বাড়তি বোঝার মতো মনে করা হয় তাকে। আর শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লে সবার কেমন করুণ দৃষ্টি তাদের প্রতি!

নগরায়ণের ফলে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের অনেক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একসময় আমাদের দেশে প্রবীণদের প্রতি যতটা শ্রদ্ধা, সম্মান দেখানো হতো এখন তার কোনই লক্ষণ নেই। বরং প্রবীণরা যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না ভেবে তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে তারা অসহায় জীবনযাপন করে আরও বেশি। এবং তাদের এ পরিস্থিতিতে তারা একাকিত্বে ভুগতে থাকে বেশি। বয়সের সঙ্গে মানুষের আচরণ পরিবর্তন হয়। অনেকটাই শিশুসুলভ আচরণ করেন তারা কিন্তু তাদের এই মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাদের তাচ্ছিল্য করা হয় বেশি। যা তাদের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু তারও সঠিক চিত্র নেই। অর্থাৎ ধর্ম-বর্ণ- লিঙ্গভেদে বাংলাদেশ সব প্রবীণ নাগরিকের জন্য বয়স্ক ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যাতে গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলের সব প্রবীণ নাগরিক এ আওতায় আসে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসলে প্রবীণরা অনেকটাই জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা -২০১৩ দ্রুত বাস্তবায়ণ করতে হবে। সরকার, সরকারি গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া পারস্পরিক সমোঝোতা, সামাজিক নিরাপত্তা, সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা, পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক মনোভাব, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রবীণ নারীদের শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থ রাখার অন্যতম উপায় পরিবারের সদস্যদের পূর্ণ সহোযোগিতা। সরকারি ভাতা, সুযোগ -সুবিধার পাশাপাশি পরিবারকে প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে তাদের প্রতি দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের। এছাড়া প্রবীণ নারীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। সর্বোপরি প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল হতে হবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ