পোস্টারে পুরুষতান্ত্রিকতা!
বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় বড় বড় অক্ষরে ‘ধূমপান নিষেধ ‘ লেখা পোস্টার হার হরহামেশা সবারই চোখে পরে। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই ধূমপান নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত একটি কাজ। কিন্তু ‘মেয়েদের ধূমপান নিষেধ’ লিখিত পোস্টারের যুক্তি কি? সমাজ ও আইনের চোখে যে বিষয়টি অপরাধ তা লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই অপরাধ। তবে পাবলিক প্লেসে এমন প্রহসনমূলক জনসচেতনতার মূলে কি?
দেশের আইনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার ( নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ অনুসারে কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবেন না৷ এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং সেই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বারবার একই ধরণের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ হারে দণ্ডনীয় হবেন।
এই আইনের কোথাও কোনো লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণের উল্লেখ করা হয় নি। সমস্ত নিষেধাজ্ঞা এবং সাজা সবার জন্য একই। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এমন প্রহসনমূলক পোস্টার পাবলিক প্লেসে টাঙানো হয়? ছবির পোস্টার ঘিরে তৈরি হতে পারে হাজারটা প্রশ্ন। পোস্টারটি দেশের নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের চায়ের দোকানের। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের চায়ের দোকানের চিত্র যেমন হয়, এখানেও তেমনই। শিক্ষার্থীদের হুইহুল্লোর, আড্ডা, চায়ের চুমুকে আনন্দ।
একটি পোস্টারকে ঘিরে সামনে এলো বৈষম্য, সংকীর্ণ মানসিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা আর অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে ঘাটি গেঁড়ে বসে আছে।
সুন্দর এই দৃশ্য যখন চোখে শান্তি এনে দিতে পারে তখন দোকানের দেয়ালে লাগানো এই পোস্টারে চোখ পরলে মনে প্রশ্ন জাগবে সমাজ নিয়ে, সমাজের চিন্তাধারা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে মুক্ত চিন্তা করতে শেখানোর কথা সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিচ্ছেন বৈষম্যমূলক পোস্টারের দিকে তাকিয়ে৷ দোকানের শুরুর দিকে এমন কোনো পোস্টার ছিলোনা বলে জানান শিক্ষার্থীরা। তবে হুট করেই এমন পোস্টারের আবির্ভাব হওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা দায়ী করেন অনেকগুলো বিষয়কে।
কেউ কেউ বলেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী শিক্ষার্থীদের( কেউ কেউ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত) স্বেচ্ছাচারিতা, দোকানদারের সমাজকে ভয়, নারীদের চুপ করে মেনে নেয়া সর্বোপরি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল শিক্ষার্থী উদ্বুদ্ধ করেন এমন পোস্টার তৈরির জন্য। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি এই পোস্টার নিয়ে দোকানের মালিককে জিজ্ঞেস করলে বলেন, মেয়েদের সিগারেট খাওয়া দেখতেও ভালো লাগেনা এই কারণে পোস্টার।
সিগারেট শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটি জিনিস। প্রতিটি মানুষের উচিত ধূমপান থেকে দূরে থাকা। কিন্তু এই দোকানীর মত সিদ্ধান্ত যখন সমাজ দিয়ে দেয় যে, নারীর ধূমপান দেখতে দৃষ্টিকটু তবে পুরুষের ধূমপান দৃষ্টি-নন্দিত তখন সমাজে বৈষম্য তো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। আর এর থেকেই সৃষ্টি হয় ঘরে-বাইরে নারীকে হয়রানি ও হেনস্তার মতো ঘটনাগুলোর৷
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো দোকানের দেয়ালে ঝুলে থাকা এই পোস্টার নিয়ে তেমন প্রতিবাদ করেননি কোনো শিক্ষার্থী। কারো মনে প্রশ্ন জাগলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে কিংবা সমাজের ভয়ে মুখ বুঝেই মেনে নিয়েছেন। আবার অনেকেই পোস্টার এর সঙ্গে সহমত পোষণ করছে বলেই চুপ থেকেছেন।
রাজশাহীর ঘটনা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। কিভাবে প্রকাশ্যে ধূমপানের জন্য এক তরুণীকে হেনস্তা করা হয়। ভুলে যাওয়ার কথাও নয়, কারণ বাঙালিরা নারীর হেনস্তা হওয়ার ঘটনাগুলো মনে রাখতে পছন্দ করেন। যাই হোক, রাজশাহীর সেই ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক। রাজশাহীর সার্কিট হাউজ রোডের পাশে বসে প্রকাশ্যে ধূমপানের কারণে স্থানীয় কিছু মানুষের হাতে হেনস্থার শিকার হতে হয় এক তরুণীকে। সেই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। হয় নানান আলোচনা -সমালোচনা। তবে কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো একটিই কথা, ‘নারীর ধূমপান অপরাধ’।
বেশ কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নারীর ধূমপান নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বললেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ। তিনি বলেন, “প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সামনে মেয়েদের হাতে সিগারেট দেখি। এক হাতে কাপ, এক হাতে সিগারেট। একটা ছেলে, একটা মেয়ে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করতেছে, সিগারেট খাচ্ছে। এটা কোন সংস্কৃতিতে পরে, কোন শিক্ষায় পরে? ” জাতীয় সংসদের মতো একটি জায়গায় নারী স্পিকার, নারী প্রধানমন্ত্রীর সামনে একজন সংসদ সদস্য এমন প্রহসনমূলক বক্তব্য দিতে পারলে দোকানীর সহজ ভাষায়, মেয়েদের ধূমপান দেখতে ভালো লাগেনা বলাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এবার সেই পোস্টারের ঘটনায় ফিরে যাওয়া যাক। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো দোকানের দেয়ালে ঝুলে থাকা এই পোস্টার নিয়ে তেমন প্রতিবাদ করেননি কোনো শিক্ষার্থী। কারো মনে প্রশ্ন জাগলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে কিংবা সমাজের ভয়ে মুখ বুঝেই মেনে নিয়েছেন। আবার অনেকেই পোস্টার এর সঙ্গে সহমত পোষণ করছে বলেই চুপ থেকেছেন। কেউ কেউ তো বিষয়টিকে নিয়ে ব্যাপক মজা লুটছেন।
একটি পোস্টারকে ঘিরে সামনে এলো বৈষম্য, সংকীর্ণ মানসিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক স্বেচ্ছাচারিতা আর অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে ঘাটি গেঁড়ে বসে আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সমাজের প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। মানতে হবে আইন সবার জন্য সমান৷ মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা শিখতে হবে। মনে রাখতে হবে, পোস্টার টাঙানোর মতো এমন ছোট্ট একটি পদক্ষেপও সমাজে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা তৈরির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।