একটি কার্টুন যেভাবে শিশু অধিকারের প্রতীক হলো
‘মীনা কার্টুন’-এর মীনা চরিত্রটি ৯০ দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত একটি চরিত্র। কার্টুন ছবির সেই মীনা চরিত্রটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েশিশুদের প্রতীকী চরিত্র। শহরে শিক্ষিত পরিবারে মেয়েশিশুরা স্কুলে পড়তে পারলেও গ্রামের মেয়েশিশুরা শত ইচ্ছা থাকলেও স্কুলে পড়তে যেতে পারে না।
মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই ঘরের কাজ করতে হয় মায়ের সহযোগী হয়ে। আর খাবার খেতে বসলে ছেলে সন্তানের জন্য ভালো পুষ্টিকর খাবার বরাদ্দ থাকলেও; মেয়েশিশুর ভাগ্যে জুটত স্বল্প পুষ্টির কম খাবার। সমাজে মেয়েশিশুদের প্রতি যে বৈষম্য ও অবহেলা করা হতো; সে সবই ফুটে উঠতো দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করা ‘মীনা’ কার্টুন’টিতে। এভাবে মীনা চরিত্রটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব, ছেলেমেয়েতে পুষ্টিকর খাবারের বৈষম্য ঘুচাতে কাজ করেছিল। এ কার্টুন ছবিটি তৈরি করেছে ইউনিসেফ। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, যেহেতু এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক অবস্থানে ছেলে মেয়েতে বৈষম্য আছে ও অনেক জায়গায় মেয়েদের অবস্থানকে খাটো করা হয়, তাই মীনা কার্টুন নতুন প্রজন্মের জন্য আরও অনেক বছর চলমান থাকা উচিত।
মীনা কার্টুনে আরো দুটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিল, মীনার ছোট ভাই রাজু ও তাদের পোষা টিয়াপাখি। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোকে উৎসাহিত করতে ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত হয় মীনা কার্টুন। মীনার সেই সচেতনতার কারণেই হয়তো আজ ২৮ বছর পর মেয়েদের বিজয় কেতন উড়ছে চারদিকে। সুযোগ দিলে মীনারাও সবকিছু দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, তার প্রমাণ প্রতি পদে পদে দিয়ে চলেছে মীনারা। সম্প্রতি সাফ নারী ফুটবল-২০২২ টুর্নামেন্টে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন ‘মীনারা’। জাতিসংঘ শিশু তহবিল—ইউনিসেফ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েদের শিক্ষাসহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে নব্বই দশকে ‘মীনা’ নামের ধারাবাহিক কার্টুন তৈরি করে। মীনা হলো এই ধারাবাহিকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। মীনা ৯ বছরের মেয়ে, যে শিক্ষার অধিকার চায়, সব ধরনের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। মীনার সেই সচেতসতার কারণে আজ প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এখন এগিয়ে গেছে বলে বলা হচ্ছে।
আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব মীনা দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারিভাবে দিবসটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। মীনা চরিত্রটি কাল্পনিক হলেও; বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বালিকা চরিত্র। জাতিসংঘ শিশু তহবিল—ইউনিসেফ ঘোষিত এই দিবস মেয়েদের বিদ্যালয়ে যেতে সক্ষম শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ এবং ঝরে পড়া রোধের অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্বে পালিত হয়।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘নিরাপদ ও আনন্দময় পরিবেশে মানসম্মত শিক্ষা’। সরকার, এনজিও ও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সহযোগিতায় ‘ইউনিসেফ’ ঘোষিত দিবসটি উদযাপিত হবে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও পূর্ব-এশিয়ার দেশগুলোতে দিবসটি উদ্যাপিত হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ঢাকা পিটিআইতে (মিরপুর-১৩) সকাল ৯টায় আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন প্রধান অতিথি এবং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সভাপতিত্ব করবেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত। এছাড়া দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গল্প বলার আসর, বিশেষ ব্যক্তিত্বরা শিশুদের উদ্দেশে প্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান, পাপেট শো ও মাপেট শো, স্টল প্রদর্শনী, রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন, যেমন খুশি তেমন সাজো ও মীনাবিষয়ক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য অনুসারে, গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েশিশুর ভর্তি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। প্রাকপ্রাথমিক ও প্রাথমিকে ২০১০ সালে মোট ভর্তি হয়েছিল ১ কোটি ৮২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯১ শিশু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে মেয়ে ছিল ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ২১০ জন, যা ছেলেদের তুলনায় অর্ধলাখের বেশি। ২০২০ সালে ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১টি শিশু ভর্তির মধ্যে মেয়ে ছিল ১ কোটি ৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৫১ জন, যা ছেলেদের তুলনায় সোয়া ৪ লাখের বেশি। এক দশকে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমেছে আড়াই গুণের বেশি, ছেলেদের দুই গুণ বেশি।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট নাজনীন আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, মীনা কার্টুন চরিত্রটি শিশুশিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েশিক্ষায় অগ্রগতি এনে দিয়েছে। এই কার্টুনের সবচেয়ে বড় যে সাফল্য, হলো—সহজ ও আকর্ষণীয়ভাবে ছোট বয়স থেকে শিশুদের মননে যে বিষয়গুলো দরকার তা শিখিয়েছে। মেয়েরাও যে ছেলেদের থেকে কোনো কিছুতে কম নয়, সে বিষয়টা বুঝিয়ে দিয়েছে। এই মীনা শুধু বাংলাদেশ নয়; দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তাদের ভাষায় করা হয়েছে ফলে এটাকে মানুষ নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। যেহেতু এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক অবস্থানে ছেলেমেয়েতে বৈষম্য আছে; এবং অনেক জায়গায় মেয়েদের অবস্থানকে খাটো করা হয়, সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি মীনা কার্টুন মানুষের সচেতনতা এবং জেন্ডার সমতার এই কার্টুন চলতে থাকতে হবে।