Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিবাহবিচ্ছেদের দায় কেন নারীর উচ্চশিক্ষার?

যুগ পাল্টাচ্ছে। মানুষ পাল্টাচ্ছে। সেইসঙ্গে পাল্টাচ্ছে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার। এত পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষভাবেই নারী-পুরুষের জীবনেরও রদবদল ঘটছে। পুরুষ-নারী সবাই জীবনকে স্বাভাবিক ও সহজ-সরল পথে চালিয়ে নিতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এককথায় মানুষ এখন অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করেন।

পুরুষ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে ঘরে-বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই আজীবন নিজের জায়গা অটুটভাবেই দখল করে রেখেছেন। পক্ষান্তরে নারী ঘরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রেই আজীবন কোণঠাসা। জন্মের পর থেকেই কন্যা শিশুর সঙ্গে চলে একধরনের লুকোচুরি খেলা। অনেকটা চাপিয়ে দিয়ে, দমিয়ে রেখেই তাদের গড়ে তোলা হয়। এরফলে নারীদের মধ্যেও একধরনের পোষমানা স্বাভাব গড়ে ওঠে। বাবা-মা একজন কন্যা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন পরিবার-সমাজের নিয়ম-কানুন, নীতি-নৈতিকতার নানারকম ফাঁদ। যেই ফাঁদে নারীকে গড়ে তোলা পুতুল স্বরূপ। করা হয় শোষণের অন্যতম কান্ডারি। শাসকের ভূমিকায় থাকতে থাকতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভুলেই যায় নারীরাও মানুষ।

তবে আজকের দিনে এসে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা, শোষণ, বঞ্চনাকে নারীরা পায়ে ঠেলতে শিখেছে। সমাজের রক্তচক্ষুকে কড়া চপেটাঘাত করতেও শিখেছে। এর প্রমাণ হিসেবে নারীর বর্তমান অগ্রযাত্রা। নারীরা সর্বক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে গড়ে তুলছেন আপন ভুবন। শুধু কোনো একটি বিশেষ জীবনকে নয়, বরং নিজের কাছেই নারীরা নত হচ্ছেন। অন্যায়ের সম্মুখে নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শোষণ যখন চরম মাত্রায় তখন তিনি নারী হন বা পুরুষ অবশ্যই নিজেকে টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। আমাদের সমাজে হচ্ছেও ঠিক তাই। ডিভোর্সের হার বর্তমানে বেশি। কিন্তু কেন ডিভোর্স বাড়ছে? আর শিক্ষিত নারীরাই বা কেন ডিভোর্স বেশি দিচ্ছেন? ডিভোর্স কি নারীকে শিক্ষিত করার ফল? না কি প্রচণ্ড পরিমাণে অবদমিত, শোষিত, নিপীড়নের শিকারে নারীর কড়া জবাব?

দীর্ঘদিনের শোষণ যখন চরমে ওঠে একটি মানুষ তখনই অপর ব্যক্তি থেকে আলাদা হন। ভালোবাসার ঘাটতি হলে ঠিক বাড়ির পশুটিও কিন্তু একসময় গৃহত্যাগ করে।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানও স্পষ্ট। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, কয়েক বছর ধরে দেশে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে এটা বেশি হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। গত ২২ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকায় প্রতিদিনে তালাক হচ্ছে ৩৯ জনের। যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে তার অধিকাংশই হচ্ছে শিক্ষিত নারীর পক্ষ থেকে । এমনকি চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে তালাকের ঘটনাও বেশি ঘটছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, তালাকের আবেদন বেশি হচ্ছে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। উত্তর ও দক্ষিণে তালাকের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে।

বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বেশির ভাগই ‘বনিবনা না হওয়াকে প্রধান কারণ রূপেই তুলে ধরেছেন । এছাড়া স্ত্রীর করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে ভরণপোষণ না দেওয়া, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত। আর স্বামীদের আবেদনে স্ত্রীর বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। যৌক্তিক বিচারে কোন কারণগুলো সঠিক বলে মনে হচ্ছে? পুরুষের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ কতটা যৌক্তিক? নারীদের সঙ্গে যেখানে ঘটছে যৌতুকের মতো জঘন্য ঘটনা সেখানে পুরুষেরা বলছেন উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, অবাধ্য হওয়ার কথা! সেক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীর ওপর দায় চাপিয়ে পুরুষতন্ত্র নিজেদের দোষ ঢাকতে চেষ্টা করছে।

আগের যুগে নারীকে শুধুই ঘরে আবদ্ধ রাখা গেলেও এখন নারীরা অনেকটা সচেতন। নিজের জীবনকে প্রধান্য দিতে নারীরা পরিবার-সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারছেন। এর অন্যতম কারণ শিক্ষা তবে একমাত্র কারণ নয়। শোষণ যখন চরমে প্রতিবাদও তেমনই প্রগাঢ় হবে এটাই স্বাভাবিক। আজকের দিনে এসেও পুরুষ চায় সর্বদা নারীকে শোষণ করতে। দমিয়ে রাখতে। যার ফল ডিভোর্স।

দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি হওয়ার অনিবার্য ফল ডিভোর্স। কিন্তু অবনতি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন নারীকে ডিভোর্সের সম্মুখীন হতে হচ্ছে? নারী মানেই কোমলপ্রাণের অধিকারী। মায়ের জাত। দীর্ঘদিনের শোষণ যখন চরমে ওঠে একটি মানুষ তখনই অপর ব্যক্তি থেকে আলাদা হন। ভালোবাসার ঘাটতি হলে ঠিক বাড়ির পশুটিও কিন্তু একসময় গৃহত্যাগ করে। আর নারী প্রচণ্ড পরিমাণে মানুষ। খুব বেশি অভিমানী, আত্মসম্মানের অধিকারী। নারীদের ভালোবাসার ক্ষমতা যেমন পাহাড়সম ঠিক ঘৃণাও ততটাই। ফলে যখন নারীরা প্রতিনিয়তই নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, কাজের যোগ্য মূল্যায়ন পাচ্ছেন না, শ্রদ্ধা, সম্মান সর্বোপরি কোনো রকম ভালোবাসার লেশমাত্র থাকছে না এবং নারীদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে একটু স্বস্তির বাতাস নিতে তখনই বেশিরভাগ নারী ডিভোর্সের পথে হাঁটছেন।

দিনশেষে যার মঙ্গল কামনায় নারীরা সবথেকে বেশি সময় পার করে দেন যখন সেখান থেকেই বিপরীত আচরণ প্রাপ্ত হয় তখন নারীরা আর চুপ করে থাকছেন না।

ডিভোর্স নারীদের পক্ষে বেশি। তার কারণ কিন্তু শিক্ষা নয় বরং বোঝা উচিত পুরুষের অত্যাচার কত বেশি আজকের যুগে এসেও? আর নারীদের শিক্ষা থাকার কারণে কাজটা অনেকটা সহজ হচ্ছে নারীদের জন্য। কারণ শিক্ষা অবশ্যই চক্ষু উন্মুক্ত করে। অর্থাৎ ভালো-মন্দের তফাত বোঝাতে সাহায্য করে। ফলে বর্তমানে নারীদের থেকে বেশি ডিভোর্সের কারণ নারীরা সচেতন হচ্ছেন। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে বুঝতে শিখেছেন। নানি-দাদির আমলে তাদের সঙ্গে যা হতো, সেটাকেই নিয়তি বলে মেনে নিতেন। অত্যাচারের সম্মুখীন হলে সেটাকে মানিয়ে নিয়েই জীবন পার করে দিতেন। যা এখন ঘটছে না। এর কারণ অবশ্যই শিক্ষা। আর সবচেয়ে নেপথ্যে আছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। যা নারীকে একধাপ এগিয়ে দিচ্ছে।

শিক্ষার ফলে নারীরা নিজেদের সম্মানকে বাড়িয়ে তুলছেন। মূর্খ পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে ভাগ্যের পরিহাস করে তুলছেন না। বরং যোদ্ধা হয়ে আজীবন পরিবার-সমাজের সঙ্গে লড়াই করে নিজের অবস্থান করে তুলছেন।

শিক্ষার সঙ্গে ডিভোর্সের কোনোই সংযোগ নেই। বর্তমানে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কোনো নারীই আর আগের মতো পুরুষতন্ত্রের নির্যাতনকে সহ্য করে পড়ে থাকছে না। এটাই পার্থক্য। তবে শিক্ষা নারীর জন্য অনেকটা বিষয়গুলো সহজ করে তুলেছে। নারীরা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে শিখছে। দিনশেষে যার মঙ্গল কামনায় নারীরা সবথেকে বেশি সময় পার করে দেন যখন সেখান থেকেই বিপরীত আচরণ প্রাপ্ত হয় তখন নারীরা আর চুপ করে থাকছেন না। এর দায় যদি কারও নিতেই হয় তবে অবশ্যই পুরুষতন্ত্রের শোষণমূলক মনোভাব। এই মনোভাবের যতদিন পরিবর্তন না ঘটবে ততদিন এই চিত্র আরও দীর্ঘ হবে। পুরুষতন্ত্রের প্রভুসুলভ মনোভাব নারীকে শক্তি জোগায় নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দায় দিয়ে বসে না থেকে আগে নিজেদের শোধরাবার চেষ্টা করুন। সচেতন হন নারীর সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার প্রতি। তবেই হয়তো এ ঘোর অমানিশা কাটবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ