ম্যাচসেরা কৃষ্ণা
কৃষ্ণার হাত ধরে বাঘিনীদের জয়
আমাদের আছে একজন কৃষ্ণা রাণী সরকার, যার চোখের চাহনিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় প্রতিপক্ষের ডিফেন্স।
নেপালের জালে দেওয়া তিন গোলের দুটোই এসেছে টাঙ্গাইলের মেয়ে কৃষ্ণার পা থেকে। জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলো, মেয়ের আগ্রহ দেখে মাত্র চল্লিশ টাকা ধার করে একটি ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন বাবা। যে বলের পিছনে ছুটে বেড়াতো দিনরাত। তাই তো রাগ করে মা কেটে ফেলেছিলেন সেই বলটাই। বল কেটে ফেলেছিলেন কিন্তু স্বপ্ন তো কেটে ফেলতে পারে নি। কটাক্ষ; কটূক্তি, অভাব; অপ্রাপ্তি থামাতে পারে নি কৃষ্ণাকে। গ্রামের লোকেরা একসময় বাঁকা চোখে দেখলেও, এখন তাকে নিয়েই গর্ব করেন।
টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার পাথালিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। পিতা বাসুদেব সরকার ও মাতা নমিতা রানী সরকার। বাবার অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়ে বেড়ে উঠতে লাগল “কৃষ্ণা”। সাধারণত ছোটকাল থেকেই মেয়ে শিশুরা পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, কুলা এসব নিয়ে খেলা করে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণা ব্যস্ত থাকতো ভাইদের সাথে সারাদিন সাইকেল, ডাংগুলি আর ফুটবল নিয়ে।
কৃষ্ণার এসব কাণ্ড দেখে গ্রামের লোকেরা নানা ধরণের কথা বলতে লাগল। কৃষ্ণার মা নীরবে হজম করতেন সে সব কথা। সে যখন নিজ গ্রামে খেলতো তখন প্রতিবেশীরা বাড়ির উপরে এসে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করে যেতো। তারা ভাবতো কৃষ্ণার সাথে মিশলে অন্য মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে।
কৃষ্ণার মা যখন সফল জননী হিসেবে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ পদক পাওয়ার পর জেলায় যাচ্ছিলেন তখন কৃষ্ণার মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়- কৃষ্ণার সাথে ঘটে যাওয়া আপনার সাথে সবচেয়ে আনন্দ দায়ক / বেদনা দায়ক ঘটনাটি কী?
মূহুর্তেই তাঁর চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, একদিন প্রতিবেশীরা প্রচণ্ড বকেছিল অকথ্য ভাষায়। আমি সেদিন কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি রাগে, ক্ষোভে দৌঁড়ে গিয়ে বটি নিয়ে বসি। এরপর কৃষ্ণার বলটাকে কুটিকুটি করে কেটে ফেলি। কাটার পর যখন ওর কান্না দেখি তখন মনে হলো আমি আমার হৃৎপিণ্ড কেটে কুটিকুটি করেছি। ততক্ষণে মেয়ের চোখ থেকে এক নদী অশ্রু গড়িয়েছে। মা-মেয়ে জড়াজড়ি করে প্রচণ্ড কাঁদলাম। চোখের পানি মুছে কাল-বিলম্ব না করে সেদিনই তাকে বল কিনে এনে দিলাম। বল হাতে পেয়ে মেয়ে আমার কী যে খুশি হলো তা ভাষায় অবর্ণনীয়।
এই ঘটনার কিছুদিন পর শুরু হলো বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট। কৃষ্ণা খেলতে এলো উত্তর পাথালিয়া প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী হিসেবে সূতী ভি এম সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক জনাব গোলাম রায়হান বাপন-এর চোখে কৃষ্ণার নৈপুণ্যতা ধরা পড়ে। ততক্ষণে সারা গোপালপুরে কৃষ্ণা কৃষ্ণা রব উঠে গেছে। অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুল লতিফ কৃষ্ণার বাড়িতে যান। তারপর পরিবারের সাথে কথা বলে কৃষ্ণাকে সূতি ভি এম স্কুলে ভর্তি এবং খেলাধুলার অনুশীলনের দায়িত্ব নেন।
শুরু হলো কৃষ্ণার জীবনের নতুন অধ্যায়। দিনগুলো একদিকে যেমন ছিল আনন্দঘন অন্য দিকে তেমন চরম সংকটাপন্ন। কৃষ্ণার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ০৯ কিলোমিটার। ভোর পাঁচটা ৩০ মিনিটে উঠে খেয়ে না খেয়ে কৃষ্ণাকে যেতে হতো অনুশীলনের মাঠে।
দেশ আজ গর্বিত কৃষ্ণার মতো সন্তান পেয়ে।কৃষ্ণা শুধু আমাদের নয়, সে আজ সারা বাংলার সম্মান।শত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে বাংলার বুকে বিজয় এনে দিয়েছে, কৃষ্ণা! কৃষ্ণা বাংলা মায়ের বুকে বারবার বয়ে নিয়ে আসুক এমন অনাবিল আনন্দ।
অনন্যা/এসএএস