কোন সম্পর্কে নারী নিরাপদ?
বর্তমানে যেভাবে খুন, গুম, ধর্ষণ, যৌন-হয়রানি বেড়েছে,তাতে করে বিবেকসম্পন্ন মানুষেরা প্রচণ্ড পরিমাণে মানসিক চাপে পড়েছেন। একইসঙ্গে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে,নারীর নিরাপত্তা নিয়েও নারীকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে নানারকম কথা হয়ে আসছে। এর যেন শেষ নেই। নারী যেন পরিবারের বোঝা, সমাজের বোঝা, রাষ্ট্রের বোঝা। নারীর প্রতি এহেন অন্যয়-অবিচার-নিপীড়ন-অত্যাচারের সুরাহা কি আদৌ হবে না? না কি ‘নারীর জন্মই আজন্ম পাপ?’ নারী হয়ে জন্মেছে বলেই আজীবন নারীকে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দেওয়া হবে?
নারীদের আর্তচিৎকার কি এই সমাজের মানুষের অন্তরে আঘাত করে না? কতটা পশুবৃত্তি, কতটা নোংরামি মজ্জাগত হলে সব দোষ নারীর ওপর চাপিয়ে পুরুষতন্ত্র শাহেন শাহ’র মতো জীবনযাপন করতে পারে। বিবেক কি একটুও নিজের অপরাগতাকে ধিক্কার জানায় না? নারীরা আজকাল গণপরিবহনে ধর্ষিত হচ্ছে, যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছে, ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। কয়জন আইনের শাসন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো, মানসিক বিকৃত রুচির পরিবর্তন নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন? সবাই শুধু পড়ে আছে নারীর পোশাকে। পোশাকই যদি নারীর জীবনে অপমৃত্যু, আত্মহত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ, যৌন-হয়রানি, ইভটিজিংয়ের কারণ হয়, তবে ভেবে দেখুন তো বাবার কাছে সন্তান কেন নিরাপদ নয়? শ্বশুরের চোখে কেন সন্তানসম বউমাকে দেখলে লালা ঝরে? বোনকে দেখে কেন নিজের পাশবিক কামনা জাগে ভাইয়ের? নারী কোন সম্পর্কে নিরাপদ?
ঘরের বাইরে নারীর জন্য অপ্রীতিকর পরিবেশ আজকের কথা নয়। কিন্তু ঘরের মধ্যে কী দিয়ে অপরাধকে ঢাকতে চান ? গত ২৭ আগস্ট বেসরকারি বিশ্বিবদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী রাজধানীর দক্ষিণখানের মোল্লারটেক এলাকার একটি ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি হত্যা বা আত্মহত্যা যাইহোক না কেন, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি চিরকুট জব্দ করেছে। যেটাকে সুইসাইডাল নোট হিসেবেই ধরে নিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আমি বলতে চাই, এই চিরকুটে উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে। সেখানে লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা দায়ী। একটা ঘরে পশুর সঙ্গে থাকা যায়। কিন্তু অমানুষের সাথে না। একজন অত্যাচরী রেপিস্ট যে কাজের মেয়েকেও ছাড়ে নাই। আমি তার করুণ ভাগ্যের সূচনা।’ এই অংশটুকুতে যেটুকু নোটেড, তা থেকে মেয়ের ওপর বাবার পাশবিক অত্যাচরের কাহিনি বিবৃত। এখানেও কি একশ্রেণি পোশাকের খুঁত খুঁজতে চেষ্টা করবে?
কিছুক্ষণ আগে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে একটি ঘটনা সামনে এলো। শ্বশুর হাতে পুত্রবধূকে ধর্ষণচেষ্টা। এক্ষেত্রে কী বলবে সুশীল সমাজ? কী বলবে যারা প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে নারীর পোশাককে দায়ী করছেন? আইন, আদালত, প্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা, সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা, নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ করার বিপক্ষে যারা, তারা কী বলবেন? যদি পক্ষে হতেন, তবে তো এই শিক্ষিত নামধারী লোকজন নারীর পোশাকে আটকে থাকতেন না। তবে এই গৃহবধূর কী দোষ? শিক্ষার্থীর কী অপরাধ? তিনি পোশাক ছোট পরে ঘুরছিলেন? না কি তিনি নারী?
নিজের গর্ভে যেই ছেলে সন্তানটি জন্ম নিচ্ছে, সে যেন আরেক নারীকে দেখে মুখিয়ে না ওঠে। নিজ ঘর থেকে শুরু করি পরিবর্তন। তবেই হয়তো ধীরে ধীরে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।
কোন সম্পর্ক, স্থান নারীকে সুস্থ পরিবেশ দিচ্ছে আমাদের সমাজ? অফিসে, পরিবহনে, রাস্তায়, শপিংমলে, রেস্টুরেন্টে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, হসাপাতালে ? কোথায় নারী নিরাপদ? কোন সম্পর্কে নারী নিরাপদ? যেই ঘরে পরম আশ্রয় মমতায় সন্তানকে বেড়ে তুলছেন, স্বামীকে জল পর্যন্ত স্পর্শ করতে দিচ্ছেন না, দেবরের পড়াশোনার পর্যন্ত দায়ভার গ্রহণ করছেন, শ্বশুরের অসুস্থতাকে সর্বোচ্চটা দিয়ে সেবা করার চেষ্টা করে চলেছেন, সেখানেও নারী আজ তুচ্ছ। ভোগের সামগ্রী। একপক্ষ শুধু দিয়েই যাবে। আর পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসী মনোভাবধারীরা শুধু চাপিয়েই যাবে?
তাই তো বাবার কাছে কন্যা নিরাপদ নয়, স্বামীর ঘরে স্ত্রী নিরাপদ নয়। তবে কি নারীরা বাঁচতে ভুলে যাবে। নিজেকে চার দেওয়ালে আবদ্ধ করে গুমরে মরবে? কী চায় আমাদের শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত পুরুষতন্ত্র? নারীদের দেখলেই শিশ্নের ওঠা-নামা শুরু হয় ? তাহলে পুরুষ দেহের নিয়ন্ত্রণও কি নারী নেবে?
এত এত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখে মনের মাঝে একধরনের বিষাদ, একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব ঘটনা মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে। ভাবতে গেলে নিজের মাঝেই বেঁচে থাকার অনীহা বাড়ে। কোন সমাজে আছি আমরা? কী আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে? এত বিকৃত রুচি, মানসিকতার মাঝে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কত কঠিন, একজন নারী মাত্রই জানে।
অফিস যাবেন, সেখানে যেন বসের কুনজর এড়ানো যায়, তার জন্য সর্বদা আপনাকে নজর দিতে হবে। বাইরে বের হবেন সেখানে আপনি নারী হলে আপনাকে সতর্ক হতে হবেই। কিন্তু একজন পুরুষ কতটা সচেতন? ঘরের বাইরে বের হতে তিনি কী কী প্রটেকশন গ্রহণ করে? এমন কোনো নারী নেই, যিনি ঘর থেকে বের হতে তার পোশাক, তার সাজগোছ নিয়ে দুবার চিন্তা না করেন। একটু বেশি হলো কি না, অতিরঞ্জিত লাগছে কি না। কিন্তু যারা পুরুষ, তারা পোশাক নিয়ে কয়বার ভাবেন? রেপিস্ট হলেও তকমা পাওয়া তাদের অভ্যেস। ফলে সমাজে নারীর কোন সম্পর্কে স্বস্তি আছে? তারা কোন পরিবেশে, কোন পরিস্থিতিতে নিরাপদ?
পুরুষতন্ত্রের মজ্জাগত বস্তাপচা সেকেলে সংস্কার-কুসংস্কার পরিত্যাগ আগে করুন। মানুষ হিসেবে গ্রহণ করুন নারীকে। সামজিকভাবে সচেতন হতে হবে প্রত্যেক নারীকে। নিজের গর্ভে যেই ছেলে সন্তানটি জন্ম নিচ্ছে, সে যেন আরেক নারীকে দেখে মুখিয়ে না ওঠে। নিজ ঘর থেকে শুরু করি পরিবর্তন। তবেই হয়তো ধীরে ধীরে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। সেইসঙ্গে আইনের শাসন কঠোরভাবে এবং দৃষ্টান্তমূলকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। সন্তানদের যতটা পারা যায়, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। ফলে মনের পরিধি অনেকটা প্রশস্ত হবে। তবেই নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে আশা করি।