শামসুর রাহমানের কবিতায় নারীর মাতৃরূপ
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিদের অন্যতম শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬)। তাঁকে নাগরিক কবি হিসেবেই অভিহিত করা হয়। তাঁর কবিতায় আধুনিক মানুষের জীবনযাপন, নগর চেতনা, দ্বন্দ্ব, গ্রামকেন্দ্রিক জীবন, শহরকেন্দ্রিক জীবন, মা, প্রেম যেমন উঠে এসেছে, তেমনি তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন।
এছাড়া, তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী বাঙালির জন্য কী দুঃখ বয়ে এনেছিল, সেসব নির্মম ছবি তুলে এনেছেন কবিতায়। কবিতার আলোয় কবি দেখিয়েছেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার চিত্র সেইসঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়েছে কবির মায়ের রূপও। মা তাঁর কবিতায় একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কবির মা যেন পুরো বাংলাদেশের আবহমান মায়ের প্রতিমূর্তি।
শামসুর রাহমানের বিধস্ত নীলিমা (১৯৬৭ ) কাব্যগ্রন্থের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতায় কবি মায়ের যে মুগ্ধতার মূর্তি নির্মাণ করেছেন, তিনি সর্বজনীন মা হয়ে উঠেছেন। মায়ের রূপ যেন বাংলার প্রতিটি ঘরে এমনই। মা তাঁর সন্তানের জন্য চিন্তা করেন, শাসন-আদর করেন, পরিবারের কাজে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। সবার মঙ্গল কামনাই তাঁর জীবনের পরম প্রাপ্তি হয়ে ওঠে। মায়ের পবিত্র রূপ, নির্মল-কোমল রূপ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি।
কবি মাকে কখনো গান গাইতে শোনেননি, কবে কোনো রাতে ঘুমপাড়ানির গানে সন্তানকে আগলে রেখে ঘুম পাড়িয়েছিলেন, কবির মা যখন ঝড়ে আম কুড়ানি বয়সে ছিল, তখনো হয়তো তাঁর এরূপ উচ্ছলতার দেখাননি। কারণ পরিবারের কানে গেলে মেয়ের এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ তাদের জন্য বিব্রতকর। এই চিত্র শুধু কবির মানসপটে ভেসে ওঠা মায়ের নয় বরং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মেয়ের বেড়ে ওঠার চিত্রপট। একসময় কন্যা প্রাপ্তবয়স্ক হলে বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর ঘরে যায়। সেখানে আরও শাসন-শোষণের ভয়াবহ রূপ। তাই মায়েদের পাখা মেলে ওড়ার ঠিকানা হয়তো অজানায় থেকে যায়। কবি বলেছেন:
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়, বড় বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেঁয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনো দিন।
কবির মায়ের রূপ মনে দাগ কাটে। চেতনায় আঘাত করে। বোধকে নাড়া দেয়। এতো শুধু কবির মা নয়। এ মা বাঙালির মা। আমাদের সবার মায়ের রূপ। মায়ের দিন যায় সংসারে ভালো-মন্দের হিসেব কষে। বাজার দর আার সংসার খরচা, সামলে হিমশিম খেতে হয়।
মাছ কোটা, হলুদ বাটার ফাঁকে আর বাসন কোসন ধুয়ে, সেলাইয়ের ফাঁকে মায়ের সময় কোথায় নিজেকে নিয়ে ভাবার! মা তো এক অপরিমেয় শক্তির আধার। তাই তার নিজের চাপা কথা থেকে মনের গভীরেই। সে তল খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এত চমকপ্রদ কবিতা শামসুর রাহমানকে অমর করেছে, স্মরণীয়-বরণীয় করেছে।
কবি মনে সন্দেহ জাগে মায়ের মুখে কখনো তো গান শুনিনি। মা তাঁকে খেলার মাঠে পাঠাতে গিয়ে আড়ালে আবড়ালে দুকলি গান গুন গুন করে গেয়ে উঠেছিলেন? মায়ের জীবনে এমন সুখের কি ফুরসত মিলেছিল? মায়ের কাজের ভিড়ে মা কি তার বাইরে নিজেকে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন? কবির চেতনায় বারবার হানা দিয়েছে এই প্রশ্ন। কিন্তু তিনি থেকেছেন নিরুত্তর। কারণ কবি জানেন, মা তার সব আকাঙ্ক্ষা-চাহিদাকে গলাটিপে সিন্দুক বন্দি করে রেখেছেন। তাই তো বলছেন:
যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাছের সিন্দুকে
রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের
গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু
ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে।
মাকে নিয়ে কবির আরও একটি কবিতা স্থান পেয়েছে নিজ বাসভূমে (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘মাকে’। কবিতায় কবি উল্লেখ করেছেন মায়ের জীবনযাপন। মায়ের সংসারযাপন। মাকে কবি কিভাবে দেখেছেন, মায়ের নিভৃতচারী সেবায় মুগ্ধ করেছেন পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু নিজেকে? মা কি সে সময় বের করেছিলেন? কবি মনের প্রশ্ন তাঁকে মায়ের প্রতি নিবেদিত করেছে।
শুধু কবিই কালেভদ্রে মায়ের কাছে যান। শুধু টেলিফোনেই মা তার গলার আওয়াজ পান। মায়ের অভিমান জমেছে ছেলের প্রতি। গাছের পাতায়, ফসলের শীর্ষে, মেঘনা নদীতে, অলি গলি অ্যাভিনিউতে, শহীদ স্মৃতিসৌধে, মৌন মিছিলে কোথায় নেই কবির আনাগোনা?
কবি হয়ে উঠেছেন বাঙালির ঘরের স্বজন। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কবির মা নিভৃত গ্রামেই থেকেছেন। সংসারের খুঁটিনাটি কাজে মগ্ন থেকেছেন। কখন চারটা বাজে, কখন মেঘের পানসি ভাসে, আসমান কখন রোদে কাঁপে, কিছুই যেন মায়ের মনকে ছোঁয় না। মা একান্ত মনে নিবিষ্ট থাকে তার ঘরকন্যার কাজে। সন্তান আর স্বামীর পদসেবায়। রন্ধনশালায় নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে চলে সর্বদা। শিক্ষক স্বামীর পাতে কটা মাছ, পুঁইশাক পড়লো সব তাকে নখদর্পণে রাখতে হয়। লাউয়ের মাচায় কটা লাউ, কাটলো গাছে, চুলায় চাপানো হাড়ি সবই যেন মায়ের। কবির মা তাই যেন আমাদের মায়ের রূপ। কবি বলেছেন:
ছিলেন নিভৃত গ্রামে। সর্বক্ষণ সংসারের খুঁটিনাটি কাজে
মগ্ন, আসমানে রৌদ্র কাঁপে, মেঘের পানসি ভাসে, কখন যে ক’টা বাজে থাকে না খেয়াল কিছু।
কবির মা উঠে এসেছে তাঁর স্মৃতিপটে। কারণ এই কোমল মা আজ আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু কবির মন বিষাদে ভরে ওঠে মায়ের স্মৃতি কল্পনায়। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে ভ্যাপসা লাগে, দম বন্ধ হয়। মায়ের প্রতি কবির গভীর অনুরাগ, মায়ের প্রতি মমত্ববোধ তিনি ধারণ করেচেন এভাবেই:
এ বাড়ির গণ্ডি ছাড়া কোথায়ও পড়ে না তাঁর পায়ের পাতার
কালো ছাপ, সারাক্ষণ থাকেন আড়ালে আর খসে না থামার
কাপড় ভুলেও কারও সমুখে কখনো। বেঁচে নেই বাপজান
আম্মাও ওপারে আজ, তবু মাঝে মাঝে প্রাণ করে আনচান।
ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা ‘বহুদিন পর মাকে’ কবিতায়ও মায়ের প্রতি কবির ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। কবির মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে নানাভাবে। মাকে যেরূপে নিত্যই দেখেছেন, সেই মায়ের জীবনাচারণ কবিতায় স্থান পেয়েছে। জায়নামাজে বসে মায়ের তসবি নিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে থাকা, আলমারি গোছানো, কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে জীবনের স্বাদ তার। আলমারি থেকে কারুকাজময় শাড়ি বের করে লজ্জায় অবনত হয়ে গা জড়ায়। মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য্যের আভা যেন ফুটে ওঠে মনে। কবি এত নিবিড়ভাবে মাকে উপস্থাপন করেছেন। কবি বলেছেন:
সুরমা রঙের মেঘে রোদ্দুরের পাড়, কতিপয়
কবুতর রেলিং-এ আতিথ্য নেয়, গম
পাবে; মা আমার
দাঁড়ানো দরজাঘেঁষে, তাঁকে
কী এক উৎসব
ত্যাগ করে গেছে, মনে হয়।
শামসুর রাহমানের কবিতায় যেমন মাকে নিয়ে নানরকম উপলব্ধি, ভালোলাগা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি মায়েরও যে ছেলের প্রতি কিছু আদেশ, উপদেশ, কথা বলার থাকতে পারে, সেই ধারণার প্রয়োগ দেখিয়েছেন কখনো কখনো। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’ (১৯৮৫)-এর ‘মা তার ছেলের প্রতি’ কবিতায় মায়ের পক্ষ থেকে কবির উপলব্ধির সাক্ষাৎ মিলেছে। মায়ের সঙ্গে কবির বহুদিন দেখা নেই। মা এখন বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তার বাচ্চুকে বহুদিন দেখেননি। দিনের চেঁচামেচি, হট্টগোলে নানাজনের কথা শুনতে পেলেও সন্তানের দেখা নেই। কবির সব ভাই কাছে থাকেন। শুধু কবিই কালেভদ্রে মায়ের কাছে যান। শুধু টেলিফোনেই মা তার গলার আওয়াজ পান। মায়ের অভিমান জমেছে ছেলের প্রতি। গাছের পাতায়, ফসলের শীর্ষে, মেঘনা নদীতে, অলি গলি অ্যাভিনিউতে, শহীদ স্মৃতিসৌধে, মৌন মিছিলে কোথায় নেই কবির আনাগোনা? শুধু মা-ই তাঁর সাক্ষাৎ পান না। তাই মায়ের আর্তি সন্তানের প্রতি। কবির কবিতায় মায়ের নিবেদন ফুটে উঠেছে এভাবে:
আমার ইন্দ্রধনু বয়সে তোকে আমি
পেটে ধরেছি দশ মাস দশ দিন, তোর নাড়ি-ছেঁড়া
চিৎকার এখনো মনে পড়ে আমার
মনে পড়ে তোর হামাগুড়ির মুখের প্রথম বুলি।
কবি যেমন মায়ের প্রতি ভালোবাসায় অবনত হয়েছেন। ঠিক মায়ের পক্ষ নিয়ে মায়ের আর্তিও ফুটিয়ে তুলেছেন। মা এক অনবদ্য সত্তায় বিরাজ করে। মায়ের স্নেহ, পরম মমতা সন্তানকে প্রতিনিয়ত ঘিরে রাখে। শামসুর রাহমানের কবিতায় মা যেন মায়ের সবটুকু নিয়ে অবস্থান করেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় মা হয়ে উঠেছেন আবহমান বাঙালি জাতির মাতৃরূপ।