রুক্মিণী: অন্তরালেই যার ভাঙা-গড়া
বিদর্ভের রাজকন্যা রুক্মিণী। বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা ও শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী। রুক্মিনী লক্ষ্মীর অবতার। রুক্সিণীর অসাধারণ রূপ লাবণ্যে শ্রীকৃষ্ণ আকৃষ্ট হন। রুক্মিণীও শ্রীকৃষ্ণের গুণাবলিতে অনুরক্তা হয়ে তাকে পতিত্বে বরণ করতে মনস্থির করেন। কিন্তু মাঝে বাধ সাধে রুক্মিণীর ভাই রুক্মী। ভাই রুক্মী ছিল কৃষ্ণবিদ্বেষী। তাই কোনোমতেই বোনের বিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে দিতে রাজি হয় না।
রুক্মী পরশুরামের কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেন। কংস হত্যাকারী হওয়ায় রুক্মীর বিদ্বেষ ছিল কৃষ্ণের প্রতি। তাই মগধের রাজা চেদিরাজ দমঘোষোর পুত্র শিশুপালের জন্য রুক্মিণীকে প্রার্থনা করে বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। চেদিরাজ দমঘোষ ও মগধরাজ একই গোত্রের। ফলে শিশুপাল জরাসন্ধের কাছেই বেড়ে ওঠে। আর এখান থেকেই শিশুপালের সঙ্গে কৃষ্ণবৈরী ভাব শুরু হয়। জরাসন্ধের জামাতা কংসকে বিনাশ করেন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণবিদ্বেষী হওয়ায় রুক্মী ও জরাসন্ধ মিলে ভীষ্মকের সঙ্গেই রুক্মিণীর বিয়ের আয়োজন করে। কিন্তু রুক্মিণীর মনে বাসা বাঁধে ভয়। কারণ কৃষ্ণকেই তিনি পতি হিসেবে গ্রহণ করেছের মনে মনে। কৃষ্ণের প্রতি অনুরক্তও।
কিন্তু পারিবারের সদস্য বিশেষ করে ভাইয়ের অমত থাকায় তাকে নিজের মতকে উপেক্ষা করতে হয় তাদের সম্মুখে। কিন্তু রুক্মিণী অন্য নারীদের মতো নিজেকে বলি হতে দেননি। বরং নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মহাভারতের কাহিনিতে লেখক কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস সমাজের সাধারণ চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আবহমানকালের প্রথা বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নারীর মতের কেউ কোনো তোয়াক্কাই করে না। বরং চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি লক্ষণীয় সর্বত্র। কিন্তু রুক্মিণীর প্রতিবাদী সত্তা এবং ভালোবাসার প্রতি প্রবল বিশ্বাসই তাকে ঘর ছড়তে বাধ্য করে।
রুক্মিণীর চিঠি পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ ভাই বলরামসহ বিদর্ভে উপস্থিত হন। কৌশলে রুক্মিণীকে হরণ করেন। রুক্মিণীও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হওয়ায় নিজ থেকেই কৃষ্ণকে সহযোগিতা করে তাকে পিতৃগৃহের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। রুক্মিণীর হৃতবস্থার কথা জেনে জরাসন্ধ, শিশুপাল, রুক্মী সবাই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু পরাক্রমশালী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে লড়াইয়ে সবাই পরাজিত হয়। এরপর রুক্মিণীকে দ্বারকায় নিয়ে যথাবিধি বিয়ে করেন শ্রীকৃষ্ণ।
রুক্মিণীই শ্রীকৃষ্ণের প্রধান স্ত্রী। শ্রীকৃষ্ণের ঔরসে ও রুক্মিণীর গর্ভে একে একে দশ পুত্র জন্মগ্রহণ করে। পুত্রদের নাম যথাক্রমে প্রদ্যুম্ন, চারুদেষ্ণ, সুদেষ্ণ, চারুদেহ, সুষেণ, চারুগুপ্ত, চারুবিন্দ, সুচারু, ভদ্রচারু ও চারু। রয়েছে এক কন্যাও। তার নাম চারুমতী। কিন্তু রুক্মিণীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের জীবনযাপন নিয়ে বিরাট অংশ মহাভারতের কাহিনিতে উল্লেখ করা হয়নি। শ্রীকৃষ্ণের পরাক্রম ও পাণ্ডবদের জন্য তার ত্যাগ সবই চোখের সম্মুখে তুলে ধরেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের কোনোই ব্যাখ্যা পাঠককে দেননি। এমনকি রুক্মিণীর অংশগ্রহণ শ্রীকৃষ্ণের জন্য কতটা সুখের তারও আভাস দেননি। যেহেতু মহাভারত পাঠের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের অদ্ভুত শক্তির প্রেমে পড়ে পাঠক, তাই তার জীবন অতিবাহিত কিভাবে হয়েছে, সে অংশও জুড়ে দিলে আরও পরিপূর্ণ রূপ পেতো। আবার রুক্মিণীর মাতৃস্নেহ, পতিব্রত কিছুই যেন পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়নি।
মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শ্রীকৃষ্ণের জীবনসঙ্গী সম্পর্কে লেখক আমাদের অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যেই রেখেছেন, পরিপূর্ণ জীবনাচারণ পাঠকের সামনে তুলে না ধরে। নেপথ্য চরিত্র হলেও রুক্মিণী মহাভারতের অন্যতম একটি প্রতিবাদী চরিত্র। কারণ নিজের অধিকারকে বজায় রাখতে এবং কৃষ্ণকে জীবনসঙ্গী করতে শ্রীকৃষ্ণের পাশাপাশি সমান উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে কিছু নারী চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে খুব একটা কালক্ষেপণ করেননি। ফলে রুক্মিণী চরিত্রটিও থেকে গেছে অন্তরালে।