কাটাকম্ব: মৃতের স্তূপে রোমাঞ্চ!
মানুষের জীবনে বৈচিত্র্য খুব কমই আসে। খুব সামান্য স্থানই আমাদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পারে। রহস্যের সাথে কিছুটা ভয়ের মিশেলে কল্পনার বাঁধভাঙা কঠিন কিছু না। তারপর যখন সেখানে পৌঁছনো যায়, তখন সমীহা, আতঙ্ক, কৌতূহল নিবারণের শূন্যস্থানটিতে জমাট বাঁধে ইতিহাস। পৃথিবীতে খুব অল্প কিছু স্থানই আছে, মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে পেরেছে। তার মধ্যে প্যারিসের কাটাকম্ব সামনের সারিতেই থাকবে। মাটির নিচের সুড়ঙ্গ নিয়ে এত মাতামাতিরই-বা কী আছে! হলোই-বা এক মাইল দীর্ঘ টানেল, তাতে কী? সচরাচর প্যারিসের কাটাকম্বে ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, এমন মানুষের আনাগোনা সব সময়ই থাকে।
তবে আপনি তো আর ভূতের অস্তিত্ব আবিষ্কারে যাবেন না কিংবা ভূতের দেখাই পাবেন, সেই আশা করেও খুব একটা খুশি হবেন না। তার চেয়ে বরং একটু রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণের কথাই ভাবা যাক।
কাটাকম্বকে সমাধিক্ষেত্রই বলা চলে। তবে এই সমাধি কিছুটা ভিন্ন রকম। এই টানেলে থরে থরে সাজানো মানুষের হাড়, খুলি আর ফিমার। সৌন্দর্য সৃষ্টিতে ফরাসিদের জুড়ি মেলা ভার। মানুষের খুলি কিংবা হাড় দিয়েও যে এমন স্থাপত্য গড়ে তোলা যায়, সেটাই-বা কে ভেবেছিল? অসংখ্য অজ্ঞাতনামা লাশের স্তূপই যেন এই জায়গাটিকে কিছুটা ভৌতিক আবহ এনে দিয়েছে। তবে যারা একবার এখানে ঘুরতে আসে, তারা মুগ্ধ না হয়ে পারে না। কোথাও এক ফোঁটা মৃত্যুর ঘ্রাণ লেগে নেই।
কাটাকম্ব আসলে কী, সেটা একটু জানা দরকার। মানুষের শেষকৃত্যের নানা পদ্ধতি আছে। কাটাকম্বকে ঠিক সেই পদ্ধতিই বলা চলে। যাদের দেখবেন, তারা সবাই কিন্তু প্যারিসিয়ান। অনেকটা পুরোনো আমলের মনে হলেও এটি মূলত আধুনিক একটি সমাধিপদ্ধতি।
আঠারো শতকের শেষ দিকে স্থানীয় শাসনকর্তারা বুঝতে পারলেন, প্যারিসের সমাধিক্ষেত্রগুলোতে মৃতদেহের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। এতে বরং পরিবেশ নোংরা হচ্ছে। সেই থেকে প্রায় এক শ বছর অসংখ্য প্যারিসবাসীকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। লে হলস মার্কেটের কাছেই মূল কবরস্থানটি পাওয়া যাবে। বিভিন্ন স্তরে স্তরে দেওয়া কবরস্থানে গাদাগাদি করেই যেন লাশ রাখা হচ্ছিল। অবস্থা এত বাজে হয়েছিল যে, মূল কবরস্থানের কবর মাটি থেকে ছয় ফুটের বেশি উঁচু হয়ে গিয়েছিল। তাই, প্যারিসে কবরস্থানের সমস্যা বেশ ভয়ংকর ছিল, বলা চলে।
এই সমস্যা মেটাতে কিছুটা বুদ্ধি খাটাতেই হয়। তারা লক্ষ্য করল, মাটির নিচে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ আছে। সেগুলোই না হয় ব্যবহার করা যাক। লে ইনোসেন্ট সমাধিক্ষেত্র হতে ১৭৮৫ থেকে ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত এই সমাধি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলে। ফরাসি বিপ্লবের পরে এই প্রক্রিয়া আরো বেগবান হয়। ১৮০৯ সাল থেকেই কাটাকম্বে দর্শনার্থীরা যাতায়াত করার সুযোগ পায়। মূলত, রোমান আদলে গড়া কাটাকম্ব নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছিল। আবার ফটোগ্রাফার ফেলিক্স নাদার যখন 'মৃতদের সাম্রাজ্য' নামে একটি ছবি তোলেন, সারা বিশ্বে কাটাকম্বের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে।
কাটাকম্বে ঘুরতে যাওয়া অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিক এক ট্রিপে যাওয়ার মতো ঘটনা। লাইমস্টোনের এই সুড়ঙ্গে পৌঁছতে আপনার ৪৫ মিনিট সময় লেগে যাবে। অবশ্য, সম্পূর্ণ সুড়ঙ্গ সবার জন্য উন্মুক্ত না। কিছু কিছু হাড় একদম স্তূপ করে রাখা। আবার কিছু কিছু জায়গায় যেন একটা প্যাটার্ন বা শেপ দেওয়া হয়েছে।
এখানে প্যারিসের প্লেগের মড়কে আক্রান্ত মানুষ আছে, স্বাভাবিক মৃত্যুপ্রাপ্তরাও আছে। হয়তো সবার নাম জানা সম্ভব না, তবে কিছু কিছু জায়গায় কোন কবরস্থান থেকে এদের আনা হয়েছে তার কিছু বর্ণনাও পাওয়া যাবে।
কাটাকম্বে ঘুরতে গেলে অক্টোবর থেকে মার্চের ভেতর যাওয়াই ভালো। এ-সময় ভিড় কম থাকে। আর এমন সংকীর্ণ জায়গায় অনেকেরই ভিড় ভালো না-ও লাগতে পারে। সংকীর্ণ বলে আবার জায়গাটিকে উষ্ণ ভাববেন না, কাটাকম্বের ভেতরে বেশ ঠান্ডা। সেখানে গেলে অবশ্যই একজন গাইড সাথে নেবেন।
কাটাকম্বের কিছু জায়গায় ঘুরে দেখার একেবারেই সুযোগ নেই। সে-ক্ষেত্রে আর কিছু করার নেই। তবে প্যারিসে কয়েক দিন থাকলে, কাটাকম্ব ঘুরে না হয় বিকেলটায় সুন্দর কিছুর দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়। রোমাঞ্চের পাশে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসাতেই বোঝা যায়, ফরাসিরা বাঁচতেও জানে।