মরক্কোর নীল মুক্তা শেফশাওয়েন
একবার মরক্কো গেলেই ব্যস্ত দোকানদাররা আপনাকে ডেকে বেড়াবে। কয়েক সেকেন্ড পর পরই ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনার গন্তব্য জিজ্ঞেস করবে। এমন জায়গায় আবার কেউ ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করে? সেটা তো খোদ আমাদের দেশেই অনেক আছে। মরক্কো না গিয়েই বলে দেওয়া চলে, প্রচণ্ড গরমে হাপিত্যেশ হয়ে ক্লান্তিকর এমন যাত্রা কেউ চায় না।
তবে অনেকেই হয়তো আপনার কথার সাথে একমত হতে পারবে না। মরক্কোতেই অসাধারণ এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে গেলে সারা জীবন আপনি মনে রাখবেন। এই তো, গাড়িতে চড়ে মরক্কোর উত্তরাঞ্চল দিয়ে রিফ পর্বতের দিকে এগোলেই শেফশাওয়েনের দেখা মিলবে। একবার এই শহরে গেলে হয়তো মত কিছুটা বদলাবেন আপনি। যেন স্বর্গ ফুড়ে বেরিয়েছে এই শহর।
নীলের রাজ্য কোথায়? এক আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীলের মাঝেই দেখা যাবে শেফশাওয়েনকে। মরক্কোর নীল মুক্তা বলে পরিচিত এই শহরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরই মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পুরো শহর হালকা নীলে মুড়ে রাখা। প্রতিটি স্থাপনাই নীল রং দিয়ে রাঙানো। নীল হয়তো বেদনার রং। সেই ভাবনাতে কিছুক্ষণ ছেদ ঘটাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি দেখে যতটুকু মুগ্ধ হবেন, বাস্তবে তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে। এই শহরের আছে চমৎকার এক ইতিহাস। সেই ইতিহাস জেনে নিলে হয়তো ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছাটাও দৃঢ় হতে পারে।
মরক্কোতে যত সুন্দর শহর আছে, তার মধ্যে শেফশাওয়েন একটি। ১৭৪১ সালে মোল্লা আলি বিন শমশের এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। মূলত পর্তুগিজ আক্রমণ ঠেকাতেই দুর্গ হিসেবে এই শহরের উৎপত্তি ঘটে। পরে ১৪৯২ সালে ঘোমারা গোত্র, মরিসকস এবং ইহুদিরা এই দুর্গের চারপাশে বসবাস শুরু করে। প্রায় দুই দশক পরেই মুসলমান ও ইহুদিরা এসে এই শহরকে আরো বিস্তৃত করে। স্পেনের গ্রানাডায় মুসলমান এবং ইহুদিদের যখন জোর করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা হয়, তখন তারাও অভিবাসন শুরু করে।
এই অভিবাসনকারীরা এসেই বাড়িগুলো নির্মাণ করে তাতে চুনকাম করে। এমনকি প্রতিটি বাড়ির সামনেই সিটরাসগাছ লাগানো হয়। এতে পুরো শহরেই ইউরোপের আদল চলে আসে। কিন্তু নীলই বা কেন? একটি গল্প থেকে জানা যায়, যাযাবর ইহুদিদের অভিবাসী দল এখানে আসার পর একটি প্রথা নিয়ে আসে। তারা যেখানেই যায়, সেখানেই সব কিছু নীল রং করার চেষ্টা করে। নীল রং তাদের আকাশের কথা মনে করায়। এমনকি তারা যেন ঈশ্বরের নিকটে আছে বলে মনে হয়। তবে আরেকটি গল্প আছে, এই শহরের মানুষ নাকি মশা আর ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্যই নীল রঙের ব্যবস্থা করে।
এই নীল রং অনেকটা পানির প্রবাহের চিত্র তুলে ধরে। তাতে হয়তো মশা কম হবে বলেই স্থানীয়দের বিশ্বাস ছিল। এ-ছাড়া, নীল রং খুব সহজেই গরমের দিনে ঘরবাড়ি ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। এই শহরে একবার ঘুরতে গেলেই এ নিয়ে কত গল্প শুনবেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
এমনিতে শহরটিতে মানুষ বেশ কম। আশপাশেই তাঞ্জির আর ফেজের মতো বড় দুটো শহর। অন্য অনেকেই মারাকেচ বা সাহারাতেই যাওয়ার চেষ্টা করে। এখন যেহেতু এই শহরটিও জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে, সেহেতু ঘুরে আসাই যায়। এখানকার মেদিনাতে অনেক এন্টিক শপ খুঁজে পাওয়া যাবে। সেখানে হাতে-বোনা তোয়াল আর পেতলের চায়ের কাপ বিক্রি হয়। এ-ছাড়া, পুরো শহরে তেমন গাড়ি-ঘোড়া নেই। মরক্কোর আর যেকোনো শহর থেকে এই শহর একদম শান্তশিষ্ট। এখানেই পর্বতের বাতাস এবং ঝরনার পানি আপনাকে চাঙা করে তুলতে পারে।
শেফশাওয়েন মেদিনা যেন অদ্ভুত এক জায়গা এই শহরে। মোজাইক প্যাটার্নগুলো অদ্ভুত। দিনের বেলাতেও নীলের বিভিন্ন রকমভেদ আপনাকে মরীচিকার মতো পথ ভুলিয়ে দেবে।
একই রাস্তায় কয়েকবার হেঁটেও চিনতে পারবেন না। সিঁড়ি দিয়ে হাঁটুন। নেমে নতুন ম্যুরাল খুঁজে বেড়ান। আবার পথের মাঝে পানির ফোয়ারা দেখেই থমকে দাঁড়ান। সোমবার, বৃহস্পতিবার বা শনিবার হলেই সকাল-সকাল বাজারে ঘুরে আসুন। স্থানীয় কৃষকরা এখানেই তাজা ফসল বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করতে আসে, সপ্তাহের এই তিন দিন। আর যদি ভাগ্যক্রমে বৃষ্টি হয়, তাহলে শহর যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
শেফশাওয়েনের চারপাশে অনেক পর্বত আছে। চারপাশের ভূমি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সময় থাকলে কিছুক্ষণ হাইকিংও করা যাবে। থাকা-খাওয়ার জন্যও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। পাশেই ট্যানজিয়ার শহরে এয়ারপোর্ট। বাসে তিন ঘণ্টার পথ। তাই ফেজ থেকে শেফশাওয়েনে পৌঁছানো কঠিন কিছু না। মরক্কোর নীল মুক্তা শেফশাওয়েনে কয়েক দিন কাটালে সময় মন্দ কাটবে না। সাথে মনে রাখার মতো কিছু ছবিও নিয়ে আসতে পারবেন আপনি।