নারীর সাজসজ্জায় ‘পুরুষের’ বিদ্বেষ কেন?
জগতে নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন সত্তা। স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষের জীবনচেতনা-আচরণ-সাজসজ্জায় পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজব্যবস্থা পুরুষের আচরণের স্বেচ্ছাচারিতার পৃষ্ঠপোষক হলেও নারীর সাজসজ্জায় স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। উল্টো নারীকে প্রতিনিয়ত দমন-পীড়ন করেই যেন তার স্বস্তি।
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, নারী-পুরুষ উভয়েই স্ব-স্ব রুচি অনুযায়ী নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির চেষ্টা করে। সেদিক থেকে পুরুষের পোশাক নিয়ে নারীর ন্যূনতম বিদ্বেষ না থাকলেও নারীর পোশাক-সাজসজ্জা নিয়ে পুরুষের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের শেষ নেই! ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও নারীর স্বাধীন সত্তায় পুরুষতন্ত্র বরাবরই আস্থাহীন। এখন প্রশ্ন উঠছে, নারীর সাজসজ্জার প্রতি পুরুষতন্ত্রের এত বিদ্বেষ কেন?
নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজকে শতগুণ যোগ্য করে তুলতে নিজের সৌন্দর্যকেও একধাপ বাড়িয়ে নিতে চায়। এজন্য পরিধান করে নানারকম পোশাক। সেইসঙ্গে সাজ-সজ্জায় রাখতে চেষ্টা করে বাড়তি দৃষ্টি। কিন্তু নারীর পোশাক-সাজসজ্জা নিয়ে বারবার আঙুল তোলা হয়! স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে কি নারী নিজের মতের অনুসারী হতে গেলেই কতিপয় পুরুষের গাত্রদাহের কারণ হতে হয়। কথা হলো, পুরুষের পোশাক-সাজে যদি কোনো বিধিনিষেধ না থাকে, তাহলে নারীর বেলা থাকবে কেন? এটা শুধুই ধর্মান্ধতা! না নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার ফন্দি?
বাঙালি জাতির একটি বড় অংশ আজও ধর্মান্ধ! যুক্তি-তর্ক, বিচার-বিশ্লেষণের তোয়াক্কা তারা করে না। কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যখন প্রতিনিয়ত নবায়ন করছে নিজেদের, তখন আমরা মান্ধাতার আমলেই নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছি। ধর্মান্ধ চেতনাকে সমূলে উৎপাটন করা ছাড়া নারীকে পুরুষের পাতা ফাঁদ থেকে রক্ষা করা কঠিন। বিবেক-বুদ্ধি ও মানবতার দ্বারা নারীর চলার পথকে মসৃণ করে তুলতে হবে। তবেই জাতির বিজয়গাঁথা রচিত হবে।
নারীর পোশাক-সাজসজ্জাকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির পুরুষের লালসা জাগ্রত হয়! কিন্তু পোশাক বা সাজসজ্জা যে নিছক উসিলা মাত্র। অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে দেখবো, নারীর পোশাক বা বয়স কোনো ব্যাপার নয়। ধর্ষকের হাত থেকে শিশুরাও ছাড় পায় না। এক্ষেত্রে শিশুর পোশাকে তো পুরুষজাতির সমস্যা হওয়ার কথা নয়! এ থেকে বোঝা যায়, সমস্যা পোশাকে নয়, সমস্যা মানসিকতায়। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারকে পুঁজি করে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য বজায় রাখতে নারীর পায়ে শেকল পরানোর চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। এরই অংশ হিসেবেও পুরুষ ধর্ষণ-যৌন হয়রানির আশ্রয় নেয়!
সুশিক্ষার অভাব নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়াচ্ছে! তাই জাতিকে সুশিক্ষিত করে তোলা গেলে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে। এক্ষেত্রে পরিবার থেকেই শিক্ষার হাতেখড়ি হওয়া উচিত। কারণ পরিবার শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। পরিবারের সবার শ্রদ্ধা-সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। নারীর সাজসজ্জায় পুরুষের বিদ্বেষকে রুখতে এটিই উত্তম পন্থা।
যেখানে রাখ-ঢাক সেখানেই আগ্রহের জন্ম হয় বেশি! এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। তাই সময়মতো নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র সত্তা ও উভয়ের স্বভাব-সৌন্দর্য ও শারীরিক সম্পর্কের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষালয় থেকেই এই শিক্ষা দিতে হতে হবে। এতে মানব শিশু শৈশব থেকে শারীরিক পরিবর্তন ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক-সাজসজ্জা বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা পাবে। এর ফলেই নারীর প্রতি পুরুষ সহিংস আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে।
আরেকটি কথা বলা জরুরি। তাহলো, নারীর সাজসজ্জাকে কেন্দ্র করে সমাজে যে পরিস্থিতি বর্তমান, তার পরিবর্তন করতে হলে নারীর প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। তাই নারীকে তার নারী সত্তার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। স্বীকৃতি দিতে তার একান্ত যৌক্তিক-বাস্তবসম্মত ব্যক্তিগত রুচি-অভিরুচিরও। তাহলেই নারীর পোশাক-সাজসজ্জা নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য বন্ধ হতে পারে।