Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেন অস্টেন

ভিক্টোরীয় যুগের ইংল্যান্ড। সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে তখনো সাহিত্যের বড় প্রভাবনী ক্ষমতা আছে। তবে আধুনিক ইউরোপের সব আধুনিকতার মাঝেও নারীরা চিরকাল অবহেলিত। যেখানে নারীর শিক্ষা গ্রহণেরই ছিল নানা বাধাবিঘ্ন, সেখানে সাহিত্যচর্চায় নারীর উপস্থিতি পুরোপুরি আশা করাটাও মুশকিল। কিন্তু সীমাহীন অন্ধকারের মাঝেই পরিসীমা নির্ধারণে আলোর উৎপত্তি ঘটেই। ভেবে দেখুন, বারো বছর বয়স্ক এক মেয়ে হঠাৎ একদিন ৫০০-এর বেশি গল্পের বইয়ে ঠাসা এক লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে আছে। গল্পের জগতে তাঁর চকচকে চোখ ঠিকরে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে। আঠারো শতকের আর যে কোনো নারী থেকেই বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠবেন এই বালিকা। সেই বারো বছর বয়সেই নাটক আর গল্প লেখার হাতেখড়ি পেয়ে গিয়েছিলেন। একদম শৈশবেই সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করাটাও মহান শিল্পীর লক্ষ্মণ। হয়তো এখনো ঠিক আন্দাজ করতে পারেননি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হোন বা না হোন, জেন অস্টেনের কথা ঠিকই শুনেছেন।

 

হ্যাঁ। রোমান্টিক যুগের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক, ঠিকই শুনেছেন, শুধু নারী সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচয় তাঁর নয়। বরং ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম অগ্রগণ্য সাহিত্যিক হিসেবে এখনো জেন অস্টেন পরিচিত। দূর্ভাগ্য বলতেই হবে, জীবদ্দশায় অন্তত যতটুকু গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তা তিনি পাননি। খুব সামান্য লোকই তাঁর লেখার মাহাত্ন্য বুঝতে পেরেছিল। মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে জেন অস্টেন যেন একজন ক্ল্যাসিক লেখক হয়ে উঠলেন। এই যাত্রাটুকু কেমন ছিল? সেটাই আজ আমরা একটু নজর বুলিয়ে দেখব।

 

জেন অস্টেন

 

 

১৭৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক অভিজাত পরিবারে জেন অস্টেনের জন্ম। স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নেওয়ায় হয়তো জেন অস্টেনের জীবনে দুর্ভাগ্য কিংবা জীবিকার সংগ্রামের মতো বিবর্ণ গল্প বলার নেই। কিন্তু তিনি ইংরেজ সমাজকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শ্যেনদৃষ্টি হেনে যেন এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। আঠারো শতকে একজন ইংরেজ নারী অন্তত লেখিকা হওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। বরং কিছুটা বিদ্যা অর্জন, আর আদব-কায়দা কেতাদুরস্ত হতে হবে। তাতে কোনো অভিজাত ইংরেজ ভদ্রলোকের সাথে বিয়ে হতে পারে। কিন্তু অস্টেনের তেমন কিছুর মোহ ছিল না। লেখক হবেন সাফ কথা। সাহিত্যে প্রতি অস্টেনের অনুরাগ বহু আগে থেকেই ছিল। কিন্তু লেখার দক্ষতা এবং লেখালেখির প্রতি তাঁর আনুগত্যই সেই সময় থেকে এই আধুনিক সময় পর্যন্ত বহু নারীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।

 

লেখালেখিকেই জীবনের সর্বস্ব বানিয়ে নিয়েছিলেন অস্টেন। ঠিক বাংলার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই লেখালেখিকে তিনি আশ্রয় করে বেঁচেছিলেন। কিন্তু দক্ষতা যতই থাকুক, নারীর এগিয়ে চলার পথটা তো মসৃণ ছিল না। অস্টেন লিখে চলেছেন, পাঠাচ্ছেন সম্পাদকদের দুয়ারে। প্রতিবারই তাঁর লেখা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেকোনো লেখকই হতাশ হয়ে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন, এমন নজির ভুরি ভুরি। কিন্তু অস্টেন এত সহজে দমে গেলেন না। তিনি তাঁর লেখা চালিয়ে গেলেন। এই সময় অস্টেন উপন্যাসও লেখা শুরু করেন। ভিক্টোরীয় যুগের উপন্যাস এখনকার মতো স্বল্প পরিসরের নয় মোটেও। ঢাউস সাইজের উপন্যাসের পেছনে প্রচুর পরিশ্রম এবং সময় ব্যয় করতে হতো। পাঠকদের তাঁর লেখার ক্ষমতা দিয়ে আনন্দ কিংবা চমকে দিতেই চেয়েছিলেন অস্টেন। ১৭৯৭ সালেই অস্টেন 'ফার্স্ট ইম্প্রেশন' নামের একটি উপন্যাস লেখেন। জেনের বাবা মেয়ের পাণ্ডুলিপি এক প্রকাশকের কাছে পাঠান। কিন্তু তারা ফিরতি চিঠি দিয়ে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

 

এই অসাধারণ মাস্টারপিস লেখার পরেও অস্টেনের বই প্রকাশনার মুখ দেখল না। কিন্তু তাতে কী? একজন-না-একজন প্রকাশক তো ছাপাবেনই। এই প্রকাশকের বিড়ম্বনা থেকে জেন অস্টেন কখনই মুক্তি পাননি। প্রায় ছয় বছর পর অস্টেনের সাথে এক নতুন প্রকাশকের পরিচয়। অস্টেন তখনো লিখে চলেছেন। সে-সময় তিনি 'এলিনর অ্যান্ড ম্যারিয়েন' বইটি রিভাইজ করেছেন। এমনকি 'সুজান' নামের একটি নতুন উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন। ভবিষ্যতে এই বইটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হবে 'নর্দাঙ্গার অ্যাবে'। তিনি সুজানের পাণ্ডুলিপি এই নতুন প্রকাশকের কাছে দশ পাউন্ডের বিনিময়ে বিক্রি করেন। প্রকাশক জানান, তিনি এই বই দ্রুত প্রকাশ করবেন। কিন্তু এখানেও বিড়ম্বনা যেন ছাড়েনি। বই তো আর প্রকাশ হচ্ছে না। জেন চিঠি লিখে শুধু আশ্বাস বাণী পাচ্ছেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছর আগে সুজানের পাণ্ডুলিপি আরেক প্রকাশ দশ পাউন্ডের বিনিময়ে আবার কিনে নেন। এতে জেন অস্টেনের স্বপ্ন পূরণে আবার বাধা দেখা দেয়।

 

জেন অস্টেন

 

অস্টেনের স্বপ্ন ছিল তাঁর লেখা প্রতিটি মানুষের হাতে হাতে থাকবে। কিন্তু প্রকাশকদের বিড়ম্বনায় জীবিত থাকাকালে এই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হয়নি। কিন্তু জেনের দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন তাঁর লেখা সমগ্র বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়বে। তাঁকে শুধু লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে হবে। ভাষাকে ছিঁড়েখুঁড়ে নির্মাণ করতে হবে অসাধারণ এক জগত।

 

লেখালেখির প্রতি ভালোবাসাই জেনকে বুঁদ রেখেছিল। আর কোনো কিছু একবার তাঁকে আকড়ে ধরলে, কোনো বাধাই তাঁকে পিছু হঠাতে পারে না। সম্ভবত তিনিই ব্রিটেনের একমাত্র লেখক যিনি কিনা জীবিতাবস্থায় কোনো স্বীকৃতি লাভ করেননি। ঠিক যেমন জীবনানন্দকেও আমরা বুঝতে পারিনি। মাত্র বারো বছর বয়সে লেখালেখি শুরুর পেছনে বাড়িতে সংরক্ষিত পাঁচ শ বইয়ের অবদান ছিল। এমনকি ঘরেও বাবা এবং মা তাঁকে লেখালেখির পেছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সমস্যা হলো, সমাজের আর পাঁচ-দশজন তো বিষয়টা ভালোভাবে নেয়নি। ধনীর দুলালীর দুই দিনের শখ বলে আড়ালে হাসিঠাট্টাও হয়তো চলত। সব মানুষের জীবনেই তো আর এ-সব মানুষের মুখে ঝামা কষে দেওয়া সম্ভব হয় না। জেনও পারেননি এবং তা কোনো ব্যর্থতা নয়। জেন বুঝতে পেরেছিলেন, সমাজের আর দশজনের কথা শুনলে আখেরে লাভ তো নেই, বরং ক্ষতির পাল্লা ভারী হবে।

 

লেখালেখি করতে গিয়ে জেন তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেননি, ভাবা যায়! তখন কোনোমতে এক ভদ্রলোকের সাথে বিয়ে না হলে কত কটূক্তি শুনতে হয়! অস্টেন সে-সব নিয়েও মাথা ঘামাতেন না। এক সাথে আড্ডা দিয়ে অভিজাত সমাজের সময় অপচইয়ে তাঁর ঘোর মানা। তাইতো ডেস্ক আর কাগজের খসখসে শব্দেই তাঁকে পাওয়া যেত। যদিও একসময় জেনকে হ্যারি বিগকাম্প নামে এক তরুণ বিয়ের প্রস্তাব দেন। জেনও রাজি হয়ে যান। দুটি মনের মিলন হয়েছিল হয়তো। কিন্তু জেন আর হ্যারির পরিবারের মধ্যে যেন অস্বস্তি একদম শুরু থেকেই পায়চারী করছিল। ফলে দুজনই ভবিষ্যৎ অশান্তির কথা বিবেচনা করে আর এই সম্পর্ক আগাননি। 

 

জেন অস্টেন

অস্টেনের জন্ম অভিজাত পরিবারে হলেও তাঁর স্বপ্নের পথ তো আর অভিজাত সমাজের ছাউনিতে মসৃণ হয়ে যায় না। খুব ছোটবেলা থেকেই অস্টেন বেশ নাজুক। কিন্তু সেই নাজুক হাল তিনি কোনোমতেই অন্যদের বুঝতে দিতেন না। সাহিত্যিক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের মতোই তিনি অসুস্থতায় ভুগতেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবীরা অস্টেনকে নিয়ে সব সময়ই চিন্তিত ছিলেন। আর এ-দিকে অস্টেন লিখছেন, তাদের পড়ে শোনাচ্ছেন। অসুস্থতাকে তিনি জয় করবেনই। সবাইকে সেই আশ্বাস দিতেন হাসিমুখে
 

লিঙ্গ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি নিজে কথা বলেননি। তবে তাঁর লেখাই যেন ইংরেজ সমাজের এক হুবহু চিত্র তুলে ধরেছে। কৌতূকের ধাঁচে লেখা পূর্ণাঙ্গ ছয়টি উপন্যাসই যেন পরতে পরতে বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়। রোমান্টিক যুগের কল্পনাসুলভ এবং ভাবালুতা তাঁকে মোটেও আকড়ে ধরেনি। লেখালেখি করছেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না যে তিনি হয়তো খুব দ্রুতই মারা যাবেন। হ্যাঁ, অস্টেন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর আয়ু ফুরিয়ে আসছে। মানুষের প্রবৃত্তি এবং তাঁর ধরনকে বোঝার জন্য হলেও অস্টেনের লেখা পড়তে হয়। এখনো বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে ইংরেজি সাহিত্যের যেকোনো পাঠকই অস্টেনের বই হাতে তুলে নেবেন। অস্টেনের গড়ে তোলা বাস্তবিক জগত আধুনিক সময়েও প্রাসঙ্গিক। জীবনের বিরক্তিকর এবং বিড়ম্বনাগুলোকে তিনি হাস্যরসাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন। অথচ এই হাস্যরসের পেছনেই যেন লুকিয়ে আছে বিষাদ।
 
ইংরেজ সমাজের বিভৎস এবং অদ্ভুত নিয়ম বা প্রথাগুলোকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর হয়তো জীবদ্দশায় তিনি মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেননি, তবু আমাদের বিচারে হয়তো ভুল হতে পারে। অস্টেন যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, বলছেন, দেখো সমস্যা কোথায়, বুঝতে পেরেছ কী-রকম বিড়ম্বনার মাঝে আছি?

জেন অস্টেনের প্রতিভা শুধু ইংরেজি সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক হওয়াতেই না। বরং তাঁর প্রচণ্ড অধ্যাবসায়, দৃঢ়তা এবং নিজের স্বপ্নের প্রতি দৃঢ় আস্থাই তাঁকে বহু নারীর অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। সাহিত্যের জগতে এর পরও আমরা বহু সাহিত্যিককে দেখব। অনেকে জীবদ্দশাতেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আবার অনেকে ছদ্মনামে লিখেছেন, আমরা জানতেও পারিনি যাকে একজন লেখক ভাবছিলাম, তিনি আসলে একজন লেখিকা। অস্টেন যেন নারী হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিলেন।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ