অলিগলি বেয়েচলা গন্ডোলার শহর ভেনিস
পর্যটকদের কাছে ইতালির আবেদন কখনই কমার নয়। বিশেষত ভেনিসের কথা তো কখনই বাদ দেওয়া যাবে না। ঠিক ছয় শ বছর আগে ভেনিসের বর্ণনা যেমনটি ছিল, ঠিকই তেমনই যেন রয়ে গেছে। ভেনিসের আবেদন যেন ফুরোনোর নয়। ভেনিসের যেকোনো প্রান্তই আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। ঐতিহাসিক শহর এখনো প্রচুর মানুষের আগমন ঘটায় কিংবা বলা যায়, আকর্ষণ করায় মানুষকে। প্রতিবছর অন্তত ২০ মিলিয়ন পর্যটক এখানে ভিড় করে। কিন্তু কেন? সেটা বুঝতে হলে তো আগে জানতে হবে। বুঝতে হবে, কোথায় কী আছে।
ইতালি একটি দ্বীপরাষ্ট্র, এ কথা বহু পুরোনো। খোদ ভেনিস শহরটি আয়তনে খুব বড় না। তবু, মূল শহর অনেকগুলো পৌরসভায় বিভাজিত। এর মধ্যে সেস্টিরিই সব চেয়ে বিখ্যাত। মূলত ১১৮টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে এই অঞ্চলগুলো গঠিত। এ-সব বিষয় নিয়ে জানার আগে একবার ভেনিসের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো যাক। অনেক আগে ভেনেতোর মানুষেরা ইতালির উত্তর-পূর্ব দিকে বসবাস করত। সে-সময় ভেনিসে মূলত মৎসজীবী মানুষেরই প্রাধান্য ছিল। মূল শহর প্রতিষ্ঠার বহু আগে অবশ্য অল্প-সংখ্যক মানুষের বাস। তখন রোমান শহরগুলোতে লুটপাট আর হামলার ভয় ছিল। অনেক শরণার্থীই এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসতে শুরু করে। তাদের নিয়েই ভেনিস শহরের পত্তন। ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যেই মানুষজন এসে এই শহরকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভেনিস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে। তবে ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে এই সংযোগ কিছুটা ব্যাহত হয়। তাই তারা স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাঙ্খা লালন করতে শুরু করে। ৭২৬ সালে এওটি বিদ্রোহের পর তারা স্বাত্বশাসন পেলেও আবার বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হয়। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেই কেটে যায় একাধিক শতক। ৯ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ভেনিস স্বাধীন নগররাষ্ট্রে রুপান্তরিত হয়। স্থলভাগের সাথে বিচ্ছিন্নতা থাকায় এবনগ আপ্লাইস নগরের কাছাকাছি হওয়ায় ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব ছিল অনেক। জলের মাধ্যমেই ক্রিট, ইজিয়ান দ্বীপ্পুঞ্জের একাংশ, ডালমেশিয়ান উপকূল এবং ভেনিস থেকে আল্পাইন পর্বতের ঢাল পর্যন্ত একটি বিশাল সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে। ১৩ শতাব্দীর মধ্যেই ভেনিস ইউরোপের সব চেয়ে ধনী শহর হয়ে ওঠে। পোপদের ক্ষমতা রোধ, রোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য তাদের বিশ্বের মুদ্রণ রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
অটোমানদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই ভেনিসের পতনের শুরু। এমনকি পনেরো শতকে পর্তুগিজদের আবিষ্কৃত নতুন নৌপথ তাদের বাণিজ্য ব্যাহত করে। এ-ছাড়া ১৫৭৫, ১৫৭৭ এবং ১৬৩০ সালের মহামারীতে ভেনিস অচল হয়ে পড়ে। এরপর ভেনিস শুধু যুদ্ধ আর ক্ষমতা হাতবদলের অধীনেই থাকে।
মুসোলিনির সময়ে, অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে কিছুটা উন্নতি হয় ভেনিসের। বর্তমানে পর্যটনশিল্পের বিকাশের ফলে এই শহর আবার হারানো জৌলুস ফিরে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তেমন বোমা হামলা না হওয়ায় ভেনিস সম্ভবত নিজের গৌরব হারায়নি।
ভেনিস এখন গন্ডোলার শহর। শুরুতে গন্ডোলাই ভেনিসের প্রধান পরিবহন মাধ্যম। এটি একটি সরু এবং দীর্ঘকায় ভেনিসিয়ান নৌকা। বিশাল লম্বা বৈঠার সাহায্যে এই নৌকা চালানো যায়। সতেরো শতকে এখানকার খালগুলো ছিল গন্ডোলায় পরিপূর্ণ। এখনো পর্যটকরা গন্ডোলায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেন অনায়াসে। এমনকি শহরের দুর্গম স্থানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এই গন্ডোলাই বলা চলে।
পর্যটনের একমাত্র মাধ্যম বলে অনেক সময় এই নৌকার ভাড়া বেশি রাখা হয়। তাই ভাড়া বেশি মনে হলে এড়িয়ে চলুন। আবার ভাড়া কম মনে হলেও সমস্যা। আগে নিশ্চিত হোন, আপনি চালককে আপনার গন্তব্য ঠিকঠাক বোঝাতে পেরছেন কিনা। সচরাচর ৪০ মিনিটের জন্য ৮০ ইউরো থেকে খরচ শুরু হয়। সন্ধ্যার পর অবশ্য দাম বাড়ে, তা ১০০ ইউরো হয়ে ওঠে। একটি গন্ডোলায় পাঁচজন উঠা যায়। এখন আপনি ভাবতেই পারেন, গন্ডোলার দাম হয়তো এমনই। না, দর কষাকষির সুযোগ আছে।
তাই কোনো বার ভেনিসে গেলে গন্ডোলার মাধ্যমেই হয়তো নতুন ভ্রমণের সুযোগ করে নিতে পারেন। এই শহরের অলিগলিতে, না হয় জলপথেই ভ্রমণ হয়ে গেল।