পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নারীদলের জয়
'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর'- কাজী নজরুল ইসলামের 'নারী' কবিতার এই লাইন দুটি দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করা যাক। এ-ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেটের যত সুখকর ইতিহাস, তার অর্ধেক কৃতিত্ব নারীদের দখলে যাবে, নাকি তারও বেশি, এবার তা হিসাব করার পালা।
ক্রিকেট-পাগল বাঙালিদের বরাবরই ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা একটু বেশি। এই যেমন ধরুন, খেলার মৌসুমগুলোতে বা বিনা-মৌসুমে হোক, অলিতে-গলিতে, দোকানপাটে ক্রিকেট নিয়ে, ক্রিকেটারদের নিয়ে ছোটখাট তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকে। আবার জয়ের সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উল্লাসও করে, ম্যাচ হেরে আবেগে চোখে জলও আসে অনেকের। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, তবু সুযোগ-সুবিধার কেন্দ্র-বিন্দুতে থাকেন কেবল পুরুষ ক্রিকেটাররা।
দর্শকদের দিক থেকে বলি আর বিসিবির অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বলি, বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা বরাবরই বেশির ভাগ সময় থাকেন আলোচনার বাইরে। বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটদলের যে অর্জন আছে, নারী ক্রিকেটদলের তার চেয়ে নেহাত কম নেই। তারা তাদের অর্জনের ঝুলিতে আজ আবার যুক্ত করল নতুন ইতিহাস। আর তা হলো, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মেয়েদের জয়, তা-ও আবার এই স্বাধীনতার মাসে, এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটনে নারীদের ওয়ান ডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ম্যাচে পাকিস্তানকে ৯ রানে হারাল বাংলাদেশ। মেয়েদের ওয়ান ডে বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের মেয়েরা প্রথম দুটি ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যায়৷ কিন্তু নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ায় তাঁরা। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নেমে বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের প্রথম জয় ছিনিয়ে নেন বাংলার বাঘিনীরা।
আজ সোমবার হ্যামিল্টনে টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানের অধিনায়ক বিসমাহ মারুফ। ব্যাটিং করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৩৪ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় বাংলাদেশ, যা ওয়ান ডেতে বাংলাদেশ নারীদলের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। ব্যাট-হাতে সর্বোচ্চ ৭১ রান করেছেন ওয়ানডাউনে নামা ফারজানা হক। এ-ছাড়া অধিনায়ক নিগার সুলতানা ৪৬, শারমিন আক্তার ৪৪ ও শামিমা সুলতানা ১৭ এবং রুমানা আহমেদ ১৬ রান করেন।
জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন পাকিস্তানের দুই ওপেনার নাহিদা খান ও সিদরা আমিন। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়বেন এই দুই ওপেনার। তাঁদের দুজনের জুটি থেকে এসেছে ৯১ রান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেননি। ২৪তম ওভারে তাদের ৯১ রানের জুটি আলগা করতে পারেন লেগ স্পিনার রুমানা আহমেদ। আউট হওয়ার আগে ৪৩ রান করেন নাহিদা। অপর ওপেনার সিদরা আমিন করেন ১০৪ রান। পরে বিসমাহ মারুফ করেন ৩১ রান, যা ম্যাচ হাতে রাখার জন্য একদমই যথেষ্ট ছিল না।
পাকিস্তানের দ্বিতীয় উইকেট পড়ে ১৫৫ রানে এবং তৃতীয় উইকেটের পতন ঘটে ১৮৩ রানে। এর পরই হঠাৎ ধস নামে তাদের ইনিংসে। ঘুরে দাঁড়ান বাংলাদেশি বোলাররা। একে একে ৯টি উইকেট তুলে নেন। সর্বোচ্চ ৩ উইকেট শিকার করেছেন ফাহিমা খাতুন। বাংলার বাঘিনীদের বোলিং তাণ্ডবে ২২৫ রানে গুঁটিয়ে যায় পাকিস্তান, আর ৯ রানে জয় লাভ করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের সাফল্যে তাঁদের প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে তাঁদের নিয়ে চলছে আলোচনা। এর আগেও এমন বহু ইতিহাস তৈরি করে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা। কিন্তু সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে বরাবরই পিছিয়ে রাখা হয়েছে তাঁদের।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে নারী-পুরুষের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এই বৈষম্য বরাবরই চোখে পরার মতো। দেশের মেয়েরা বারবার দেশের নাম উজ্জ্বল করলেও তাঁদের সুযোগ-সুবিধা খুব একটা বাড়ানো হয় না। প্রথম বারেই এশিয়া কাপ জিতে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন আমাদের নারীরা, যা ছেলেরা দু-বার চেষ্টা করেও পারেননি। তবু, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে তাঁরাই।
অন্যান্য দেশের নারী ক্রিকেটাররাও বেশ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। পাশের দেশ ভারতের কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের মেয়েদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি বেতন পান তাঁরা। ভারতে আইপিএলের মাঝে হয় মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট। ম্যাচ ফি, ডেইলি অ্যালাউন্স বাংলাদেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি সেখানে।
নানা আলোচনা-সমালোচনার মুখে বিসিবি কয়েক বার নারী ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিলেও সেটা যে যথেষ্ট ছিল না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তবুও থেমে নেই নারী ক্রিকেটাররা। শত প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে একের পর এক ইতিহাস তৈরি করে চলেছেন তাঁরা।