Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট

ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট! নারীবাদের ইতিহাসে এবং নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক পদচারণায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। নারী-স্বাধীনতার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিকেই তিনি একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তিনি তাঁর 'A Vindication of The Rights of Women' লেখেন। যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ১৭৯২ সালের ব্রিটেন। সে-সময় এ-রকম সাহসিকতার সাথে নারীর অধিকারের কথা বলাটা মোটেও সহজ কিছু না। কিন্তু কে এই ম্যারি ওলস্টো্নক্র্যাফট? অবাক হতেই হবে। অন্তত ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফটের মতো নারীরা সেই সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন বলেই আজকের নারী নিজের অবস্থা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

 

১৭৫৭ সালের ২৭ এপ্রিল লন্ডনের স্পিটাফিল্ডে মেরি জন্মগ্রহণ করেন। এডোয়ার্ড জন ওলস্টোনক্র্যাফট ও এলিজাবেথ ডিক্সনের ঘরে সাত সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট। পরিবারে সচ্ছলতার ঠিক অভাব ছিল না। অথচ, বাবার কারণে সেই সুখ যেন গায়ে সহ্য হচ্ছিল না। মদ্যপ বাবা প্রায়ই মাকে ইচ্ছেমতো মারধর করতেন। এ-সব দেখেই তাঁদের বড় হতে হচ্ছিল। কিন্তু ম্যারি সম্ভবত এই অন্যায় দেখে ভেতরে ভেতরে চটে উঠছিলেন। ১৭৮০ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তাই তিনি নিজেই উপার্জনের পথে নেমে গিয়েছিলেন। যা হোক, পরিবারে তাঁর ভাই ঠিকই লেখাপড়া করছিল। ম্যারিকেও স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল, তবে মেয়েদের তখন ঠিক লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়া হতো না। তাই, ম্যারিকেও স্কুলে আর যেতে দেওয়া হয়নি। সেখান থেকেই ম্যারি বুঝতে পেরেছিলেন, নারীদের প্রতি সমাজ ক্রমাগত অন্যায় করে চলেছে। নিজের প্রচেষ্টায় তিনি লেখাপড়া করতে শুরু করেন এবং স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন।  

 

নিজের সংগ্রামের মাঝে তিনি থেমে যাননি। অথচ, সেই অবস্থাই তো তার ছিল। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি দুই বোন ও বন্ধু ফ্যানি ব্ল্যাডকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েদের জন্যে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই ম্যারির বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনার সূচনা হয়। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদের সাথেই তাঁর যোগাযোগ হতে শুরু করে। নিজের ভাবনা এবং সংগ্রামের কথা তিনি সবাইকে জানাতে শুরু করেন। কিভাবে নারীর অধিকারকে আকার দেওয়া যায় সেটাই ছিল তাঁর চিন্তা। কিন্তু এই বন্ধুর পথ তো এত সহজে মাটি আঁকড়ে থাকতে দেবে না। হাজার হোক, ম্যারি সেই সময়ের ব্রিটিশ নারী। সমাজকে পুরোপুরি ত্যাগ তো আর করেননি। বন্ধু ফ্যানি ব্ল্যাড সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলেন। ১৭৮৬ সালে তাই স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল।

 

এবার ম্যারি কর্কে এক অভিজাত আইরিশ পরিবারে গভর্নেসের কাজ শুরু করেন। এই জায়গাতে ম্যারি কোনোভাবেই টিকতে পারছিলেন না। ফ্যাশনেবল বা লোক দেখানো ফ্যামিনিজম তাঁর ঘোর অপছন্দ। সেখানে এ-সবের বালাই নেই। এই হতাশাগ্রস্থতার মাঝেই একদিন তিনি চাকরিচ্যুত হলেন। তাতে অবশ্য ম্যারির মন খারাপ হয়নি। বরং ভালোই হয়েছিল।

 

১৭৮৭ সালে ম্যারি যেন এক নতুন পরিচয় পেলেন। শুরু করলেন লেখালেখি। লিখলেন 'দ্য ডিড্যাক্টিক থটস অন দি এজুকেশন অব ডটার'। জোসেফ জনসনের সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন ম্যারি। এই পত্রিকার বদৌলতে উইলিয়াম গডউইন, থমাস পাইন এবং এনা ব্যারবাল্ডের মতো চিন্তাবিদের সাথে পরিচিত হয় তাঁর। ভাবনার জগত আরো সমৃদ্ধ হতে শুরু করল তখন।

 

তরুণী ম্যারির জীবনে দুবার প্রেম এসেছিল অবশ্য। প্রথমেই তাঁর জীবনে আসে মার্কিন ঔপন্যাসিক ও ব্যবসায়ী গিলবার্ট এমল। দুজনের প্রেম থেকে বিয়ে হয়নি। তবে ফেনি এমল নামে একটি কন্যাসন্তান হয়েছিল। গিলবার্টের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমেই পরিচয় উইলিয়াম গডউইনের সাথে। গডউইন আর ম্যারি দুজনই সামাজিক বন্ধন বা বিয়ের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু ওলস্টোনক্র্যাফট অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাওয়ায় অনাগত সন্তানের কথা ভেবেই দুজন বিয়ে করেন। ভবিষ্যতের জন্য ম্যারি রেখে গিয়েছিলেন ম্যারি গডউইন নামে এক অসাধারণ প্রতিভাধর মেয়ে। এই ম্যারি গডউইনই একদিন 'ফ্রাংকেনস্টাইন'-এর মতো বিখ্যাত এক উপন্যাস লিখবেন।

 

যা হোক, ১৭৯০ সালে ম্যারি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডমুন্ড বার্কের 'রিফ্লেশন অন দ্য ফ্রেঞ্চ রেভুলেশন'-এর প্রতিবাদে লিখে বসেন 'অ্যা ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব মেন'। বার্ক ছিলেন সনাতনী সমাজব্যবস্থার পক্ষে। নারীকে তিনি ব্যক্তি-মর্যাদা দিতে রাজি নন। তবে বার্কের ভাবনা তৎকালীন পুরুষ-সমাজও এত ভালোভাবে নেয়নি। ম্যারি যেন অন্য পুরুষদের থেকেও অনেক এগিয়ে ছিলেন। তাঁর আঘাত ছিল সত্যিই বার্কের জন্যে ভয়াবহ। তাঁর বইয়ের মধ্যে তিনি দাবি করেন, প্রাকৃতিকভাবে নারীরা পুরুষদের চেয়ে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। তাঁর প্রস্তাব ছিল, নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে যুক্তিবাদী সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

 

মূলত নারীকে 'Weaker Vessel' বলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম। মিলিসেন্ট ফসেট কিংবা ভার্জিনিয়া উলফের মতো নারীবাদীরাও ম্যারিকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করেছেন। ম্যারির একটি উক্তি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হলো, 'আমি মনে করি, নারীরা মানব সৃষ্টির আলোকবর্তিকা, যাঁরা পুরুষের মতোই একই রকম, এবং পৃথিবীতে প্রকাশ হওয়ার অবস্থানে আছে।'

 

মূলত, তিনিই সেই সময় নারী ও পুরুষের কম্বাইন্ড শিক্ষার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, 'আমি এটার জন্য মিথ্যা শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করি, যা পুরুষদের তৈরি, অর্থাৎ পুরুষ-রচিত বই থেকে সংগৃহীত, যেখানে নারীদের মানুষ হিসেবে না দেখে নারী হিসেবে দেখা হয়েছে এবং তাঁদের মূল অবস্থান স্নেহময়ী স্ত্রী বা যুক্তিবাদী মায়ের চাইতেও উপপত্নী হিসেবে বেশি। বর্তমানের এই সভ্য সমাজে কিছু অংশ ছাড়া নারীদের প্রেমে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, যখন তাদের লক্ষ্য, ক্ষমতা ও অন্য গুণাবলিকে যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত।'

 

নিজের শরীরের অধিকার বিষয়েও তাঁর সচেতনতা ছিল। এই বইটি এখনো পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীর ওপর করা যৌন নিপীড়ন, অসহায়ত্বের দলিল হিসেবে কাজ করছে। এমনকি বাংলাতেও হুমায়ুন আজাদ তার 'নারী' বইটিতে ম্যারিকে নিয়ে লিখেছেন। বিশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ নারী আন্দোলনগুলোতে ম্যারি একজন অনুপ্রেরণার নাম হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি এখনো, ম্যারিকে বাদ দিয়ে নারীবাদী বা নারীর অধিকার আদায়ের কথা বলা মুশকিল।

 

ম্যারি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। তা-ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে থেকে। আর কন্যাসন্তানকে জন্ম দিতে গিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৭৯৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গডউইনকে জন্ম দেয়ার ১১ দিন পর এই মহিয়সী ম্যারি মৃত্যুবরণ করেন। উইলিয়াম গডউইন নিজেও মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তাঁর স্ত্রীর চলে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। স্ত্রীর স্মরণে মেয়ের নাম রাখেন ম্যারি। এমনকি 'মেমোয়ার অব দি অথর অফ দ্য ভিন্ডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান' বইটি লেখেন। এখানে ম্যারির জীবনের নানা প্রতিকূলতার কথা অকপটে তুলে ধরেন তিনি।

 

অশ্লীলতা, যৌন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা তোলার ক্ষেত্রে ম্যারির যে অবদান, তা কখনই ভোলা সম্ভব না। অথচ, সেই সময়ে সংগ্রাম ও সমাজে নিজেকে টিকিয়ে রাখার নজির যিনি গড়ে গিয়েছেন, সেই ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফটকে ছাড়া কি নারী দিবস পূর্ণ হতো?

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ