Skip to content

৮ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিমূর্ত পটের মূর্তমান নারী ফ্রিদা কাহলো

নিজেকে প্রকাশে তার কোনো দ্বিধা ছিলো না। প্রচণ্ড অভিমানি অথচ জেদি হয়েও আধুনিক চিত্রকলাকে করেছেন হতবাক। ছবির মাধ্যমে নিজেকে বারবার প্রকাশ এবং সব অভিমানের ধারাপাত জটিলভাবে তুলে ধরা সহজ কাজ তো নয়। ফ্রিদা কাহলোর পুরো নাম ম্যাগদালিনা কারম্যান ফ্রিদা কাহলো ই ক্যালদেরন। 

 

তবে শুধু ফ্রিদা কাহলো বললেই সবাই তাঁকে চেনেন। ফ্রিদা কাহলো নামটা অবশ্য তার জন্মের পরপর ছিল না। বাবা গিলেরমো কাহলো জার্মানির ফোরহেইম শহরে স্বর্ণকার এবং ফটোগ্রাফারের কাজ করতেন। হেনরিখ কাহলো এবং হেনরিয়েট ই কফম্যানের ঘরে জন্ম নেয়ার পর তার নাম রাখা হয় কার্ল উইলহেম কাহলো।

 

কিন্তু উনিশ বছর বয়সে জার্মানি ছেড়ে ম্যাক্সিকো চলে আসার পর তার নামে ফ্রিদা কাহলো যোগ করা হয়। ফ্রিদা নিজে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানির আগ্রাসনকে ভালো চোখে দেখেননি। মানুষের স্বাধীনতাকে নিয়ে তার আত্মবিশ্বাস ছিল অভূতপূর্ব। এই স্বাধীনতার পক্ষেই তিনি একসময় নিজের জীবন থেকে তিন বছর নিমেষেই অস্বীকার করেন। সেটাও শুধু ম্যাক্সিকান আন্দোলনের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্যই। সে বিষয়ে সামনেই আসছি।

 

ফ্রিদার দাবি তাঁর বাবা ইহুদি-হাংগেরিয়ান বংশোদ্ভূত। যদিও ২০০৫ সালে গিলেরমোরকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ে বিস্তারিত অনেক কিছুই জানা সম্ভব হয়। ফ্রিদার মা মাটিলদা ক্যালদেরন ই গঞ্জালেস মূলত একজন স্প্যানিশ-নেটিভ আমেরিকান। গিলেরমোরের আগেও এক স্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেয়ার সময় তিনি মারা যান। 

 

এরপর গিলেরমোর মাটিলদাকে বিয়ে করেন। সেখানে আরো চার সন্তানের জন্ম দেন মাটিলদা। ফ্রিদা তার জন্ম দেয়া তৃতীয় সন্তান। সংসার-জীবন কখনোই সুখের হয়নি মাটিলদার। সেই শৈশবের বিষাদ যেন আস্তে আস্তে ফ্রিদার ওপর ভর দিতে শুরু করেছিল। অবশ্য খুব ছোট থেকেই ফ্রিদার ভাগ্য মন্দের দিকেই ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁর পোলিও হয়। সুস্থ হয়ে উঠলেও ডান পা কিছুটা সরু ও খাটো হয়ে যায়। এতে তাঁর হাটতে অসুবিধা না হলেও দেখতে কুৎসিত লাগত। তাই তিনি সব সময় লম্বা স্কার্ট পরতেন। 

 

শুধু এটুকুই না। জন্মের পর থেকেই স্পাইনা বাইফিডা নামের এক দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে যন্ত্রণা দিত। এই রোগে মেরুদণ্ড আর পায়ের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ প্রতিবন্ধকতা থাকা স্বত্বেও তিনি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় যোগ দিতেন। আঠারো বছর বয়সেই এক ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর ত্রিশটির বেশি অস্ত্রোপচার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। মানসিক জোর ফ্রিদার কোনোকালে কম ছিল, তা অন্তত ভক্তেরা এ জন্যই দাবি করতে অক্ষম। 

 

সম্ভবত আত্মাভিমানে ভর করেই তিনি এগুলো করতেন। সহজে হতাশ হয়ে থেমে যেতেন না। আগেই বলেছি, ফ্রিদার বাবা ছিলেন একজন ফটোগ্রাফার। স্টুডিওতে বাবাকে বিভিন্ন কাজে ফ্রিদাই সহযোগিতা করতেন। এ সময় ডিটেইলিংয়ের প্রতি খুঁতখুঁতে স্বভাবটা তিনি অর্জন করেন। আর এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিই তাকে আর্ট তৈরিতে উৎসাহ জুগিয়ে যেত। 

 

অবশ্য আর্ট থেকে ফ্রিদার ঝোঁক বেশি ছিল বিজ্ঞানে। বিশ শতকের শুরুতে নারীদের মেডিক্যাল-শিক্ষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ১৯২২ সালে ফ্রিদা ম্যাক্সিকোর প্রিমিয়াম স্কুল প্রিপারেটোরিতে ভর্তি হন। লক্ষ্য মেডিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষা লাভ করা। পুরো স্কুলে মাত্র পঁয়ত্রিশজন নারী শিক্ষার্থী।

 

এ সময় তিনি এক রাজনৈতিক দলে যোগ দেন। সম্ভবত দলনেতা আলেজান্দ্রো গোমেজ আরিয়াসের প্রেমে পড়ায় তিনি এই অভিমতের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করেছিলেন। তখনো ম্যাক্সিকান বিদ্রোহ অব্যাহত আছে। ম্যাক্সিকোর রাজপথে সহিংস-সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম সাক্ষী ফ্রিদা। 

 

রাজনৈতিক স্বত্বা তার পুরোপুরি জাগ্রত। এ সময় ম্যাক্সিকান বিদ্রোহের প্রধান সাক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও তিনি নিজের বয়স কমিয়ে বসেন। ১৯০৭ সালে জন্ম হলেও তিনি দাবি করতেন, তাঁর জন্ম-সাল ১৯১০। এতে তাঁর ভক্তরা সহজেই ম্যাক্সিকান বিদ্রোহের সাথে ফ্রিদাকে মিলিয়ে নিতে পারতেন। 

 

এমনকি তিনি নিজেও বলেছেন, ‘প্রায়ই গুলিবর্ষণ শুরু হলে মা আমাদের নিয়ে লুকিয়ে পড়তেন। এ সময় অনেক বিদ্রোহীই উঠোনে এসে আমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করত। মা সাথে সাথে তাদের আরামের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে উঠতেন।’ 

 

একদিন স্কুলের অডিটোরিয়ামের দেয়ালে কাজ করতে আসেন বিখ্যাত শিল্পী ডিয়েগো রিভেরা। রিভেরার সান্নিধ্যে ফ্রিদার শিল্পীস্বত্ত্বা আবার জাগ্রত হয়। রাজনীতি ও শিল্প দুটোরই মিশেল ঘটে আধুনিক ম্যাক্সিকোর চিত্রকলার অগ্রদূত হওয়ার বীজ সেখানেই পোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু মেডিক্যাল-শিক্ষার ইতি ঘটে আরেক দুর্ঘটনায়। ১৯২৫ সালেই তিনি এক ভয়ংকর সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। 

 

ত্রিশটি অস্ত্রোপচারের পর তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হন। কিন্তু পথ কখনোই পথিকের জন্ম দেয় না। বরং পথিক নতুন পথ নির্মাণ-বিনির্মাণের মধ্যেই জীবনকে গুছিয়ে নেয়। ফ্রিদা ছবি আঁকতে শুরু করেন। তিন মাস অচলাবস্থায় তাঁর নিজের আঁকা পোর্ট্রেটগুলোই যেন তাঁকে সচল রাখে। 

 

এমনকি মা মাটিলদা নিজেও তাঁকে একটা বিশেষ ধরনের ইজেল বানিয়ে দেন। শুয়ে থেকেই ফ্রিদা ছবি আঁকতেন। বাবা তাঁকে এনে দিয়েছিলেন তুলি আর রং। এখান থেকেই বিমূর্ত ছবির ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা সবার নজর কাড়বে। বিশেষত, তাঁর 'ওয়ারিং এ ভেলভেট ড্রে' পোর্ট্রেটে কাহলোকে অন্ধকার পটে দেখা যায়। তাঁর পরনে কোমর অব্দি রাজকীয় পোশাক। বিমূর্তের মাঝে বাস্তবকে এভাবে প্রকাশ করার নজির খুব কম ন্যাচারালিস্ট আর্টিস্টের কাজে পাওয়া যায়। 

 

সুস্থ হতেই ফ্রিদা কাহলো ম্যাক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে (পিসিএম) যোগ দেন। ওখানে আবার ডিয়েগো রিভেরার সাথে দেখা। ফ্রিদা দ্রুতই রিভেরার কাছে অনুপ্রেরণা চান। রিভেরাও বুঝতে পেরেছিলেন ফ্রিদা প্রতিভাবান। দ্রুতই ফ্রিদা রিভেরার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফ্রিদার বাবা বেশ খেপেছিলেন। একে ‘হাতি ও ঘুঘুর বিয়ে’ বলেছিলেন। 

 

বিয়ের পরে ফ্রিদার স্টাইলেও বদল আসতে শুরু করে। ম্যাক্সিকান লোকশিল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ কিছুটা ফুটে উঠতে শুরু করে। তার আঁকা 'ফ্রিদা এবং ডিয়েগো রিভেরা' দেখলে বোঝাই যায় তিনি এক ঐতিহ্যবাহী ম্যাক্সিকান নারীকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। এই ছবিটির কাজ অবশ্য তিনি করেন আমেরিকাতে। ১৯৩০-৩৩ সাল মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময় রিভেরা সরকারিভাবে একটি মূর্তি বানানোর কমিশন পান। 

 

ফ্রিদা অবশ্য বেশ কটি গর্ভধারণ করে গর্ভপাতের শিকার হন। ডেট্রয়েট শহরে আরেকটি গর্ভপাত হয় তাঁর। খবর আসে মা মারা গেছেন। দুই দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকেই তাঁর এই কাজটি জন্ম হয়। আবার ১৯৩২ সালে 'হেনরি ফোর্ড হাসপাতাল' ছবিতে এক অনুর্বর উষর ভূমিতে এক নারীর সন্তান জন্মদানের দৃশ্য আঁকেন তিনি। 

 

ম্যাক্সিকান সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে বাংলাদেশের এস এম সুলতানের কথা মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই ছবিতে প্রতীকের ব্যবহার করতেন। ১৯৩৩ সালে কাহলো আর স্বামী রিভেরা ম্যাক্সিকোতে ফিরে আসেন। সেখানে তাঁরা একটি নতুন বাড়ি করেন। এই বাড়িটি রাজনৈতিক কর্মী এবং শিল্পীদের আড্ডাখানা হয়ে ওঠে।

 

ফ্রিদাকে এ সময় অনেকে স্বশিক্ষিত অধিবাস্তববাদী আখ্যা দেন। ১৯৩৮ সালেই জুলিয়া লেভি গ্যালারিতে ফ্রিদার প্রদর্শনী সফলতার মুখ দেখলে তিনি প্যারসে যান। ল্যুভর মিউজিয়াম তার 'দ্য ফ্রেম' ছবিটি কিনে নেয়। বিশ শতকের প্রথম শিল্পী হিসেবে তাঁর কাজ ল্যুভরে স্থান পায়। 

 

বিবাহিত-জীবন খুব সুখের কাটছিল না তাঁর। রিভেরার বহুগামিতা, এবং কাহলোর ছোট বোনের সাথে সম্পর্ক আর ব্যস্ততায় দরুন দুজনেই আলাদা হয়ে যান। এ সময় ফ্রিদা অসাধারণ-কিছু কাজ উপহার দেন। এর মধ্যে 'দ্য টু ফিটাস' সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য। যদিও ১৯৪০ সালেই দুজন আবার একত্রিত হন। ফ্রিদার বাল্যকালের বাসা 'দ্য ব্লু হোমেই' নতুন করে বসবাস শুরু। ১৯৪৩ সালে ফ্রিদা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইন আর্টস স্কুল লা এসমেরাল্ডাইয়ে পেইন্টিংয়ের অধ্যাপনার কাজ পান। 

 

কিন্তু শারীরিক অবস্থা তার মোটেও ভালো না। তিনি আরাম পেতে মাদকের আশ্রয় নেন। ১৯৪০-৫০ সালে বহুবার তাকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়। শেষের দিকে হাঁটতেও তাঁর অসুবিধা হতো। ১৯৫৩ সালেই তাঁর দুই পা কেটে ফেলতে হয়। ফ্রিদার ছিল প্রচণ্ড অভিমান। তবে সেই অভিমানকে তিনি প্রশ্রয় দিতে চাননি। মৃত্যুর কিছু দিন আগে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমি আশা করছি, বিদায় আনন্দের হোক, আমি আর ফিরতে চাই না!’ ফ্রিদা একজন বিশুদ্ধ নারী। 

 

নিজেকে সাজাতে ভালোবাসতেন ফ্রিদা। তবে তাঁর কাজের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। একজন মানুষ তাঁর বিমূর্ত ছবিগুলো একবার দেখেই নিজেকে মেলাতে পারেন। ব্যক্তিগত পোশাক হিসেবে তিনি তেহুয়ানা নামের এক বিশেষ পোশাক পরতেন। 

 

ম্যাক্সিকোর মাতৃতান্ত্রিক আদিবাসী গোষ্ঠী এমন পোশাক পরেন। এখান থেকেই তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং নারীর নিজস্ব শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ফ্রিদা ম্যাক্সিকোর ঐতিহ্যের ধারক, প্রতীক এবং নারীবাদীদের কাছে অভিজ্ঞতা ও সৌন্দর্যের সাহসী অনুপ্রেরণা হিসেবে এখনো প্রাসঙ্গিক। 

 

তবে ফ্রিদা বিতর্কিতও ছিলেন। নিজের আঁকার মধ্যে তিনি মানুষের মাতৃভূমির সাথে থাকা শিকড়ের পরিচয় দিয়েছেন। সে-জন্যই বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকেই আঁকি, কেননা প্রায়ই আমি একা থাকি, আর বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে নিজেকেই সব চেয়ে ভালো জানি’।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ