বিদায় গানের পাখি লতা মঙ্গেশকর
‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।’
সবাইকে নিজের সুরে হারিয়ে ফেলা মানুষটি আজ নিজেই হারিয়ে গেলেন। ‘সুর সম্রাজ্ঞী’ কিংবা ‘কোকিলকণ্ঠী’ প্রতিটি নামেই যাকে ডাকা যায়, তিনি হলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর গানের সুরে বিশ্বকে মাতিয়ে সেরা গায়িকার আসনে বসে আছেন কয়েক দশক জুড়ে।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে এলো তাদের প্রথম সন্তান। সন্তানের নাম প্রথমে হেমা রাখলেও ‘ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতীর, সেই থেকে মেয়ের নাম বদলে লতা রাখা হয়। সঙ্গীতের রথী-মহারথীতে ভরপুর ছিল লতা মঙ্গেশকরের পরিবার। লতার পরে সেবন্তীর কোল আলো করে আসেন আশা ভোঁসলে, উষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও সর্বকনিষ্ঠ হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
ছোটবেলায় গান শেখানো হলেও কোনো অগ্রগতি ছিল না লতা মঙ্গেশকরের শেখায়। তবে তাঁর বাবা দ্বীননাথ নিজের বাসাতেই অনেক ছাত্রকে গান শেখাতেন। ছাত্রকে অনুশীলন করতে বলে বাবা বাইরে চলে গেলে ফিরে দেখতেন ছোট্ট লতা ছাত্রের গানের রাগ শুধরে দিচ্ছেন। এরপর থেকেই বাবার কাছে লতার তালিমের শুরু।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে লতা মঙ্গেশকর বাবাকে হারান এবং এর পরই পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পরে তাঁর ওপর। এই সময় পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাঁকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে শেখালেন। তাঁর গাওয়া গান মারাঠি চলচ্চিত্রে ‘খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ চলচ্চিত্রের ফাইনাল কাট থেকে বাদ পড়ে গেল, কিন্তু তার পরও দমে যাননি লতা। মাস্টার বিনায়কের সাহায্যে অভিনয় শুরু করেন লতা মঙ্গেশকর। আর বিনায়কের মৃত্যুর পর লতার গুরু হন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার। গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন, বলেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গুলাম হায়দারের হাত ধরে তার জীবনে সুযোগ এল ‘মজবুর’ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড় ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’(১৯৪৯) চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’গানটি। এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা।
গানের জগতে পা রাখার পর থেকেই শত শত গানে লাখো মানুষকে আপ্লুত করেছেন লতা মঙ্গেশকর। অসংখ্য পুরষ্কার ও উপাধি এসেছে মানুষের ভালোবাসার পাশাপাশি। গত শতকের পঞ্চাশের দশকেই গান করে ফেললেন নামি-দামি সব সঙ্গীত পরিচালকের সাথে। ষাটের দশকে উপহার দিলেন Ôপিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’র মতো এখনো পর্যন্ত তুমুলভাবে বিখ্যাত সব গান। ১৯৬৩ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। সেই সময় লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। সত্তরের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথেই কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, তার বেশির ভাগ আবার চ্যারিটিও। সব-কিছুর মাঝে থেমে থাকেনি সময়, থেমে থাকেননি লতা। তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যক গান রেকর্ডকারী হিসেবে তাঁর নাম আসে। পরে অবশ্য তাঁর এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন, নিজেরই ছোট বোন আশা ভোঁসলে। মোট ৩৬টি ভাষায় রচিত তাঁর এই গানগুলোর অধিকাংশের ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে বাংলা গানও আছে অনেক।
সদা হাস্যোজ্জ্বল, অথচ পারফেকশনিস্ট ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। উর্দু গান গাওয়ার আগে নিজেই উর্দু শিক্ষক রেখে উর্দু ভাষা শিখেছিলেন। ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বার বার যখন ‘আনন্দ ঘন’নামের কাউকে ডাকা হচ্ছিল, ডকুমেন্ট বলছিল সে এখানে উপস্থিত, কিন্তু কেউ পুরস্কার নিতে উঠছিল না স্টেজে। অবশেষে লতা উঠে পুরস্কার নেন এবং মারাঠি চলচ্চিত্রের রহস্যময় সঙ্গীত পরিচালক আনন্দ ঘন-এর রহস্য এভাবেই সবার সামনে আসে।
১৯৯৯ সালে পার্লামেন্টের মেম্বার হিসেবে মনোনীত করা হলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশির ভাগ সময়েই যোগ দিতে পারেননি অধিবেশনে।
লতা মঙ্গেশকর ৩ টি জাতীয় পুরস্কার, ১২ টি বাঙালি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার এবং ৪ টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতেছেন। পুরস্কার পাশাপাশি ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’আর ২০০১ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ‘ভারত রত্ন’খেতাব অর্জন করেন লতা।
২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন লতা মঙ্গেশকর। তিনি করোনামুক্তও হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী শারীরিক অসুস্থতায় অবস্থার অবনতি হয় এবং ৬ ফেব্রুয়ারি করোনা-আক্রান্ত হয়ে ৯২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন ‘সুর সম্রাজ্ঞী’ লতা মঙ্গেশকর।