Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

'বিজ্ঞান', শব্দটি মানুষের কাছে একাধারে যেমন আশ্চর্যের আবার কঠিনও বটে। আমাদের সমাজের নারীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সকলের একটি ধারণা, নারীরা জটিল কোনো হিসেব নিকেশ বুঝতে পারেনা। আর এই ধারাবাহিকতায় নারীরা যে বিজ্ঞানে কোনো অবদান রাখতে পারেন তা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানতেই নারাজ। বর্তমান প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন হলেও উনবিংশ শতাব্দীতে এ বিষয়টি এতোটা সহজ ছিলোনা৷ তবে সেই পরিস্থিতিতেও সমাজের ধারণাকে উল্টে দিয়েছিলো মেরি কুরি। 

 

বিজ্ঞানের ইতিহাসের বই ছাপিয়ে যদি কারো নাম রঙিন কালি দিয়ে লিখতে হয় তবে তাঁর মধ্যে মেরি কুরির নাম থাকবে একদম গোঁড়ার দিকে। এরপর যদি বলেন নারীর সফলতার কথা, তবেও তাঁর নাম শুরুর দিকেই বলতে হবে। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য পুরো পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি শাখায় (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে) নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নারী হিসেবে প্রথম নোবেল জয়ের কৃতিত্বটাও তাঁরই। তবে এতো সাফল্য তো আর এমনি এমনি উড়ে আসেনি। তাঁর জীবনসংগ্রামের রয়েছে লম্বা এক গল্প। 

 

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

 

মেরি কুরির জন্ম ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ার্স শহরে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোটো। মাত্র দশ বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি। তার কিছুদিনের মাথায় বোনকেও হারান তিনি। যা তাঁর জীবনকে অনেকটাই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়৷ এক দিকে মায়ের মৃত্যু অন্যদিকে বাবার আর্থিক সংকট সবকিছু মিলিয়ে মেধাবী মেরির পড়াশোনা পরে যায় সংকটে। মেরি ও তাঁর বোন একটি ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। 

 

মেরি ও তাঁর বোন পরিবারের ঐ আর্থিক সংকটের মধ্যে একসাথে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারতেন না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন। আগে মেরির বোন পড়াশোনা শেষ করবে আর তার খরচ যোগাবেন মেরি এরপর তিনি খরচ যোগাবেন মেরির পড়াশোনার জন্য। যেমন কথা, তেমন কাজ। মেরি এক আইনজীবীর বাড়িতে গভর্নেসের চাকরি নেন৷ একসময় মেরির বোন পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তার হোন এবং মেরি পড়াশোনা শুরু করেন৷  

 

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

 

কিন্তু এরপরই বাঁধে বিপত্তি। ঐ যে শুরুতেই বললাম নারীকে বিজ্ঞানের মত জটিল বিষয়গুলোতে মানতে সমাজ একদমই নারাজ। তাই তাঁকে তখন শুনতে হয়েছিল বিজ্ঞান মেয়েদের জন্য নয়, তিনি বরং রান্নার ক্লাসে যোগ দিতে পারেন। তবে মেরি কোনো অবস্থাতেই থেমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। ১৮৯১ এর শেষের দিকে মেরি পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তিনি প্যারিসের সোরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পদার্থবিজ্ঞানে, রসায়নে এবং গণিতে অধ্যয়ন করতে থাকেন। 

 

১৯৮৩ সালে তাঁকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি দেয়া হয়। এরপর তিনি গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের শিল্পভিত্তিক গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে তিনি আরেকটি ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে ফেলোশিপ পেয়ে যান। এরপর আর মেরিকে কোনো সমস্যার মুখের পরতে হয়না। তিনি ভালোভাবে বাকি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এরপর একপর্যায়ে তাঁর জীবনে আসেন বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি। 

 

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

 

মেরির গবেষণা কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বড় একটি গবেষণাগার প্রয়োজন ছিলো। তাই অধ্যাপক জোজেফ কোভালস্কি যিনি মেরিকে সব ব্যাপারে সাহায্য করতেন তিনি পিয়েরের সাথে মেরির পরিচয় করিয়ে দেন। মেরিকে দেখেই পিয়েরে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন। এরপর দুজনে মিলে বিভিন্ন গবেষণার কাজ করেন। গবেষণা চলার সময়ে তাঁদের মাঝে তীব্র ভালোলাগা ও ভালোবাসার জন্ম নেয়। একদিন পিয়েরে সাহস করে মেরিকে প্রস্তাব দিয়ে বসেন। কিন্তু মেরি ছিলেন বাস্তববাদী। তিনি নানা অজুহাতে পিয়েরেকে 'না' বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পিয়েরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁদের বিয়ে হয়।

 

এরপর মেরি ও পিয়েরে নতুন উদ্যমে যৌথভাবে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে এই দম্পতি প্রথমে প্লিচব্লেন্ড থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পলোনিয়াম এবং পরে রেডিয়াম আবিষ্কার করেন, যা ইউরেনিয়াম হতে দশ লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই রেডিয়ামের ব্যবহার অপরিসীম। কুরি দম্পতি প্রমাণ করলেন যে, কোনো কোনো মৌলের পরমাণু ক্রমাগত ভেঙে গিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে। এই বিকিরণ অন্য কোনো পদার্থ ভেদ করেও যেতে পারে। এই ধরনের পদার্থকে বলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ, আর এই গুণকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। এ আবিষ্কারের জন্য মেরি ও পিয়েরে ১৯০৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। 

 

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

 

এই দম্পতির ঘরে ছিলো দুই সন্তান। সব মিলিয়ে সুখেই কাটছিল তাঁদের জীবন। তবে সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় পিয়েরের। এতে করে মেরি শোকে একদম ভেঙে পড়েন। তবে তিনি হার মানেননি। মেরি তাঁর ভালোবাসাকে ধারণ করে এগিয়ে নিলেন অসমাপ্ত কাজ। ১৯১১ সালে প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে পেলেন দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার, তবে এবার রসায়নে। এরপর তিনি শুরু করলেন তেজস্ক্রিয়তাকে কীভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে কাজে লাগানো যায় সে কাজ।  

 

কথায় বলে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে সবই সম্ভব। তিনি এক্স-রে যন্ত্র এবং ভ্রাম্যমাণ রেডিওগ্রাফির উন্নয়ন করেন যেগুলো পরবর্তীতে ‘পেটিটস কুরিস’ (ছোট কুরিগুলো) নামে পরিচিতি পায়। এমনকি তাঁর মেয়েকে সাথে নিয়ে ২০টি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল গুলোতে রেডিওলজিকাল ইউনিট পরিচালনা করেন। তাঁর সে অবদানের কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভাবনীয় সফলতা আসে। যার ফলাফল তো বর্তমান সময়ে আধুনিক বিশ্বে দেখতেই পাচ্ছি।  

 

মেরি কুরি, বিজ্ঞানের ইতিহাসে আশ্চর্য এক নারী!

 

তবে বিশ্বকে এতোকিছু উপহার দিতে গিয়ে একপর্যায়ে থেমে যায় তাঁর নিজের জীবনই। দিনরাত তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে নাড়াচাড়ার ফল ভালো হল না। অচিরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু হয়। তবে বিশ্ববাসী তাঁর অবদানকে ভুলেননি। এই নারী একাধারে যেমন বিজ্ঞানে অবদান রেখেছেন তেমনি অবদান রেখেছেন নারীর অগ্রযাত্রায়।  

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ