নিশ্চয়ই থামো তুমি রুমির শহর কোনিয়ায়
কোনিয়া, তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। সভ্যতার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন নিজের বুকে ধারণ করে এখনো বেঁচে আছে পৃথিবীর বুকে। এই শহরকে ঘিরে আছে একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তী। একবার দুজন দরবেশ আকাশের বুকে উড়ে যাচ্ছিলেন পশ্চিমে। আনাতোলিয়ার ঠিক মাঝামাঝি আসার পর এক দরবেশ তার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলেন, "এখানে নামবো কি?" তার সঙ্গী সমর্থন দিতেই বললেন, "কোন ইয়া!" যার অর্থ "নিশ্চয়ই, নেমে যান।" এই কিংবদন্তীকেই কোনিয়া শহরের নামকরণের কারণ বলে শনাক্ত করা হয়।
শুধু এই কিংবদন্তীতেই শেষ না। রোমান কিংবদন্তী বলে, শহরের মানুষজন এক অত্যাচারী রাক্ষসের ভয়ে তটস্থ থাকতো। এই রাক্ষসকে রোমান বীর পার্সিয়াস এসে বধ করেন। স্থানীয়রা তার সম্মানে একটি স্মারক নির্মাণ করেন। সেই স্মারকে তার ছবি বা আইকন খোদিত ছিলো। রোমানরা সেই থেকে এই শহরকে আইকনিয়াম বলে ডাকে।
সে নাম যাই হোক, কোনিয়ার সাথে জড়িয়ে আছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার কৌতুক, জালালুদ্দিন রুমির ভালোবাসা অথবা ইউনুস এমরের মানবতার স্নিগ্ধ বাণিসমূহ। শহরটি আনাতোলিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত। ভৌগলিক বিবেচনায় নিম্ন সমভূমি এবং মালভূমির সমন্বয়ে মূল শহরটি গঠিত। এর দক্ষিণে পর্বতরাজি। মূলত টরাস পর্বতে পরিবৃত একটি শহর।
খ্রিষ্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগে নিওলিথিক যুগের ইতিহাস ঘাঁটলে কোনিয়া শহরটির খোঁজ পাওয়া যাবে। এশিয়া মাইনরে অবস্থিত এই অঞ্চলেই সর্বপ্রথম কৃষিকাজ শুরু হয়। আগুনের ব্যবহারও এখানকার মানুষ শিখে। সময় হতে হতে হিট্টি, ফ্রিজিয়ানরা নতুন যুগের সূচনা করে এখানে। তারপর একসময় আলেকজান্ডার এই অঞ্চল দখল করেন। রোমান রাজা ক্লডিয়াসের আমলে এই শহরের নাম হয় ক্লডিওকনিয়াম। শুধু মুসলিম ইতিহাসের জন্যেই এই শহরের গুরুত্ব বিবেচনা করলে হবেনা। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসেও এই শহর এক জ্বলজ্বলে সাক্ষী। এখানে যিশুর শিষ্য সেইন্ট পল এসে ধর্মপ্রচারণা করেন। এমনকি দশম শতাব্দীর দিকে তুর্কিরা অভিযান শুরু করার আগেও এই শহর বাইজেন্টাইনদের অধীনস্থ ছিলো।
১০৭১ সালে বাইজেন্টাইনরা তুর্কিদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সেখান থেকেই কোনিয়া তুর্কিদের দখলে চলে আসে। প্রথমে ১০৭৪ সালে আনাতোলিয়ায় সেলজুক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইজনিক হয় এদের রাজধানী। কিন্তু ক্রুসেডে ইজনিক সেলজুকদের হাতছাড়া হলে কোনিয়াকে নতুন রাজধানী ঘোষণা করা হয়। পরের দুসো বছর প্রভাব প্রতিপত্তিতে কোনিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলোনা কেউ।
বিশেষত সুলতান আলাউদ্দীন কায়কোবাদের আমলে কোনিয়া হয়ে ওঠে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অন্যতম কেন্দ্র। বলা চলে পুরো বারো শতক ছিলো কোনিয়ার স্বর্ণযূগ। এখনো কোনিয়ায় ঘুরতে গেলে সেই আমলের স্থাপত্য এর সাক্ষ্য বহন করবে। সেলজুকদের পতনের পর স্বল্প সময়ের জন্যে কারামানিরা এই শহর শাসন করে। কারামানিদের থেকে ক্ষমতা উসমানিরা কেড়ে নেয়। কারামানি রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত অবশ্য উসমানিরা শান্তিপূর্ণভাবে শাসনভার গ্রহন করতে পারেনি।
তাহলে কোনিয়ায় দর্শনীয় স্থানগুলো কি? আসুন জেনেই নেয়া যাক।
মেভলানা যাদুঘর
"এসো, সে তুমি যেই হও না কেন,
পথিক, পূজারি, অথবা ভবঘুরে,
কিচ্ছু আসে যায়না
হতাশার ঠাঁই নেই আমাদের এখানে,
এসো, কথার মূল্য দিতে যদি নাইবা জানো,
এখানে এসো, বারবার এসো।"
রুমির কবিতায় ভালোবাসার যে বাণী ধ্বনিত হয়েছে তার প্রতি সমগ্র বিশ্বের আগ্রহই যেন এর ধ্রুবকত্ব প্রমাণ করে দেয়। রুমির পিতা বিখ্যাত আলেম আহাউদ্দিন ওলাদ বালখ থেকে কোনিয়ায় আসেন। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাকে মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তার বসবাসের জন্যে সেলজুক প্রাসাদের গোলাপ বাগানের একটি অংশে দেয়া হয়। ১২৩১ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করলে এই বাগানেই তার সমাধি দেয়া হয়। প্রথমে তার শিষ্যরা মাজার নির্মাণ করতে চাইলেও রুমি নিষেধ করেন। পরে অবশ্য ১২৭৩ সালে তিনি অনুমতি দেন। তাব্রিজের বেদরেদ্দীন এখানে মাজার নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে রুমি, তার স্ত্রী কারা খাতুন এবং মেয়ে মালিকে খাতুন এবং ছেলে মুজাফফরউদ্দীন চেলেবির সমাধিও এখানে দেয়া হয়।
১৯২৬ সালে এই মাজার যাদুঘর হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রথমে ঢুকেই সুদৃশ্য গোলাপ বাগান নজর কাড়বে। চত্বরের দুপাশের বোর্ডিং হাউজে সুফিসাধকদের আবাস। প্রতি গ্রীষ্মে ভবঘুরে দরবেশরা এখানে সমাবেশ করেন। যাদুঘরের প্রদর্শনীতে রুমির বই, কার্পেট, নানা ধাত বস্তু ও কাঠ সংরক্ষণ করে রাখা। এখানে একটি পাঠাগারও আছে যেখানে "মসনবী" এবং "দিওয়ান-ই-তাবরিজের" সবচেয়ে পুরোনো সংস্করণ দেখতে পারবেন দর্শনার্থীরা। বিশেষত যাদুঘরের সবুজ গম্বুজটি যে কারোই মনোযোগ আকর্ষণ করবে।
আলাউদ্দিন হিল
কোনিয়া প্রদেশের কারাতয় জেলায় গেলেই ২০ মিতার উঁচু এক পাহাড়ের দেখা মিলবে। সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ মূলত এই কৃত্রিম পাহাড় নির্মাণ করেন। জায়গাটা অনেকটা পার্কের আদলে গড়ে তোলা। বর্তমানেও স্থানটি একটি প্রধান বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত। অবশ্য এখন স্থাপনাগুলোর মধ্যে মসজিদগুলো টিকে আছে।
মসজিদের পাশেই ঝর্ণা বা পানির ট্যাংক দেখা যাবে। এককালে গ্রীক এবং আর্মেনীয়রা এখানে বসতি স্থাপন করেছিলো। অবশ্য তাদের ব্যবহৃত চার্চ আর দেখা যায়না। যদি সেইন্ট পল ক্যাথলিক চার্চ এখনো আছে। মূলত ইতালীয় রেলকর্মীদের ধর্মচর্চার একমাত্র জায়গা ছিলো এটি। এই পাহাড়ের পার্ক অংশটিতে সবুজের সমারোহ। বিশেষত রাত হলে আলোয় আলোকজ্জ্বল থাকে স্থানটি। নির্মল ও আনন্দময় সময়ের জন্যে এই আলাউদ্দিন হিল পার্কের জুড়ি নেই।
টাইল যাদুঘর
মূলত ভবনের টাইলসের কারুকার্যগুলোই মূল আকর্ষণ। টাইলসের বিচিত্র নকশা যে কাউকেই বিস্মিত করতে বাধ্য।
আজিজিয়ে মসজিদ
সতেরো শতকে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। উসমানি এবং বারোক সংস্কৃতির সম্মিলনে নির্মিত মসজিদ কোনিয়ার অন্যতম প্রধান দর্শনকেন্দ্র। সুলতান চতুর্থ মুহম্মদের জামাতা মোস্তফা পাশার অর্থায়নে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যদিও উনিশ শতকে এক অগ্নিকাণ্ডে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে সুলতান আবদুল আজিজ এর পুনর্নির্মাণ করেন। মেভলানা যাদুঘরের কাছাকাছিই এই মসজিদ অবস্থিত।
সেলিমিয়ে মসজিদ
অটোমান সাম্রাজ্যের প্রধান স্থপতি মিমার সিনান জীবিত থাকাকালীন এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মূলত দুলতান দ্বিতীয় সেলিমের সময়ে এই মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। এই মসজিদটি উসমানি আমলের শিল্পচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
ইনজে মিনার মাদ্রাসা
সেলজুক আমলে নির্মিত অন্যতম সেরা একটি স্থাপত্যশিল্প এটি। প্রথমে মাদ্রাসা হলেও এখন এটি যাদুঘর। দেয়ালে তাইলের কারুকাজ এবং সেলজুক আমলের কাঠ ও পাথরের দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে। ভারি কাঠের কারুকাজ যেন সেলজুক স্থাপত্যের গৌরবের সাক্ষ্য।
সিলে
কাইট হিল, চা বাগান, রেস্টুরেন্ট আর সমুদ্রপাড়ের জেটি মিলে স্থানটি কোনিয়ার ব্যস্ততম পিকনিক স্পট। এছাড়াও রোমান, বাইজেন্টাইন, সেলজুক, অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যও ধারণ করে আছে স্থানটি।
প্রজাপতি যাদুঘর
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ প্রজাপতির খামার এই প্রজাপতি যাদুঘর। তুরস্কের প্রতিকূল পরিবেশেও ১৫ প্রজাতির প্রায় ৬০০ প্রজাপতির দেখা মিলবে এখানে।
তুরস্কে দর্শনীয় স্থানের খুব অভাব নেই। বরং কোনিয়া প্রদেশেই আছে চোখ ধাঁধানো অসংখ্য স্থাপত্যশৈলী।