Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

মধ্যযুগের ইউরোপ। সাদা কাগজের বুকে কালো কালো অক্ষরের ভেতরেই সুপ্ত ঘটনাগুলোর ভেতর অসংখ্য বীরের আগমন। ইউরোপের ইতিহাসের এক জলজ্যান্ত নারী বিপ্লবীর নাম জোয়ান অব আর্ক। ১৪১২ সালের ৬ জানুয়ারি মধ্যযুগের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মের পর কেউ ভাবতেও পারেনি এই মেয়েই একদিন শতবর্ষের যুদ্ধে ফ্রান্সকে বিজয়ের আলো দেখাবে।

 

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

 

মিউজ নদীর তীরে দঁরেমি গ্রাম। জন্মগতভাবে মেয়ে হলেও পরিবারকে সাহায্য করতে গিয়ে ছেলেদের মতোই পরিশ্রম করতে হতো। সম্ভবত এভাবেই এক সাধারণ এবং পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই নিজের মনকে দৃঢ় করে তুলছিলেন। জোয়ান অব আর্ক এখন ফ্রান্সের জাতীয় বীর। তাকে ঘিরে রচিত আছে নানা কিংবদন্তী এবং সত্য ইতিহাস। হয়ে উঠেছেন এক অলীক মানুষ।

 

জোয়ানের আসল নাম নিয়ে অবশ্য অনেক মতপার্থক্য আছে। সে যাহোক, জোয়ানের বাবা জেকের সাথে খামারে কৃষিকাজও করতে হতো। মা ইসাবেলা তাকে সুতো বুনন এবং সেলাইর কাজ শেখান। বেশ সাদামাটা জীবন। ফ্রান্স তখন ইংল্যান্ডের দখলে। ইউরোপের এই দুই প্রধান শক্তির মধ্যে রেষারেষি চলছিলোই। কিন্তু আপাতসময়ে ইংরেজরাই তাদের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। আর ফ্রান্স ইংল্যান্ডের মধ্যকার রেষারেষি সাধারণ প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষকে চরম দারিদ্রের মুখে ফেলে দেয়। দঁরেমি গ্রামেও তখন দরিদ্রতার মাঝেই সকলকে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

 

16

 

স্বাভাবিক জীবনের মাঝেই জোয়ানের জীবনে কিছু অলীক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এমনিতে পড়ালেখার সুযোগ তার হয়নি। অবশ্য ইউরোপে তখনো নারী শিক্ষার প্রসার হয়নি। তেরো বছর বয়সেই হঠাৎ একদিন দৈববাণী শুনতে পান। কান পেতে নিশ্চিত হতেই জানতে পারেন কেউ বলছে, "তোমার মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের ভার তোমার কাঁধেই অর্পিত করেছে বিধি। ফ্রান্সের প্রকৃত রাজাকেই ক্ষমতায় পুনর্বহাল করতে হবে তোমায়।" আর এখান থেকেই জোয়ান অব আর্ক অলীক মানুষ হয়ে ওঠার সিঁড়িতে পদার্পণ করেন।

 

এবার জোয়ান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। দেশের স্বাধীনতা ফিরলে আবার দঁরেমি গ্রামের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসবে। বুকের ভেতর স্বাধীনতার হলদে পাখিকে ধারণ করেই জোয়ান পালিয়ে আসেন দঁরেমি গ্রাম থেকে। পেছনে তার পরিবারকে ফেলে আসার সময়ে হয়তো স্মৃতিকাতর হয়েছেন। তবে সেই আবেগ তাকে থামাতে পারেনি। তিনি রাজা সপ্তম চার্লসের সাথে দেখা করেন। সেখানে রাজার কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন। আশ্বাস দেন দৈবের সাহায্যে জোয়ান দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনবেনই। পরাধীন দেশের রাজার দুশ্চিন্তা তখন তুঙ্গে। সেখানে দৈবের প্রতি বিশ্বাস রাখাও মুশকিল। তিনি এই আবেদনকে স্বভাবতই অবজ্ঞা প্রদর্শন করলেন। কিন্তু যাজকরা যেন কিছু আন্দাজ করে। তাদের পরামর্শে রাজা আর জোয়ানকে অবজ্ঞা করতে পারেনা।

 

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

 

বিখ্যাত ফরাসি ধর্মগুরু সেইন্ট ক্যাথরিন, সেইন্ট মাইকেল জোয়ানকে নেতৃত্বের হাতেখড়ি লাভ করেন। জোয়ানের গায়ে সাদা পোশাক, হাতে পাঁচ ক্রুশের তরবারি, পেছনে ৪০০ অনুগামী সৈন্য। জোয়ান যুদ্ধে গিয়েছিলেন পুরুষের বেশে। ১৪২৯ সালের ২৮ এপ্রিল, জোয়ান তার সৈন্যদল নিয়ে অরলেয়াঁতে প্রবেশ করেন। অরলেয়াঁ তখন ইংরেজ সৈন্য দ্বারা অবরুদ্ধ। এখানে প্রথম আক্রমণেই জোয়ান বিজয়ের স্বাদ পায়।

 

সে থেকে জোয়ানের সাফল্যের শুরু। ইংরেজদের থেকে খুব দ্রুতই তুরেলবুরুজ শহর উদ্ধার করে ফেলেন জোয়ান। এমনকি পাঁতের যুদ্ধেও তিনি ইংরেজদের তুলোধুনো করেন। আস্তে আস্তে ফ্রান্স তার পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। ১৬ই জুলাই রাজা সপ্তম চার্লস আবার ফ্রান্সের রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা চার্লস জোয়ানকে পাঠান অরলিন্স এ। সেখানে দীর্ঘ দেড় বছর ইংরেজদের একাধিপত্য। জোয়ানের আগমনের নয় দিনের মাথায় ইংরেজদের পরাজয় বরন করতে হয়। শুধুমাত্র জোনের অবদানেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার শতবর্ষের যুদ্ধের যবনিকা পতন হয়।

 

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

 

এভাবেই জোয়ান অব আর্ক হয়ে ওঠেন ফ্রান্সের স্বাধীনতার এবং বিপ্লবের প্রধান অনুপ্রেরণা। জোয়ানের যুদ্ধগুলো আদপে খণ্ডযুদ্ধ। কিন্তু এসকল খণ্ডযুদ্ধে তার ক্ষুদ্র দলের সফলতা ফ্রান্সের সৈন্যদের মধ্যে অনুপ্রেরণা জোগায়। ১৮০৩ সালে খোদ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট জোয়ানকে ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক ঘোষণা করেন।

 

ফ্রান্সের এই সফলতা ইংরেজদের জন্যে ছিলো অস্বস্তিকর। তারা এই রহস্যময় যোদ্ধাকে আটকের নানা ফন্দিফিকির করতে শুরু করে। অবশেষে, ১৪৩০ সালের মে মাসে জোয়ান ইংরেজদের মিত্রবাহিনীর হাতে আটক হন। তারা ইংরেজদের হাতে জোয়ানকে সমর্পণ করে। এবার তার বিচার শুরু হয়। পিয়েরে কশন নামের এক বিশপ আদালতের বিচারকার্য শুরু করেন। এই কশন জোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ ছুড়ে দেন। এরমাঝে জোয়ানের নারী ও পুরুষের পোশাক পরার গুরুতর অভিযোগকে ভিত্তি করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অবশ্য এই অপরাধের জন্যে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া আদৌ কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলোনা। 

 

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

 

জোয়ানের বিচারটি ছিলো প্রহসনের বিচার। তাকে প্রশ্ন করা হয় তিনি আদৌ ঈশ্বরের দয়ায় আস্থা রাখেন কিনা। সাহসী জোয়ান প্রত্যুত্তরে বলেন, " যদি আমি তা না রাখি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে সেখানেই রেখে দেন, আর যদি আস্থা রাখি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন।"

 

এভাবেই জোয়ানকে ফাঁদে ফেলা হয়। এই বিচারে তৎকালীন ইংল্যান্ডের ১২ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ার একটাই পরিণতি, মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুর আগে জোয়ানকে কারাগারে রাখা হয়। সেখানে নারীদের পোশাক পরতেন। কিন্তু কারাগারে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর তিনি আবার পুরুষদের পোশাক পরতে শুরু করেন। এভাবে তিনি কিছুটা নিরাপত্তা পেতেন।

 

অলীক নারীর নেতৃত্ব: জোয়ান অব আর্ক

 

অবশেষে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দিন এগিয়ে আসে। জনসম্মুখে পুড়িয়ে মারা হয় জোয়ান অব আর্ককে। মৃত্যুবরণ করার আগে একজন তাকে জিজ্ঞেস করে, "কে গো তুমি?" তিনি দৃপ্তস্বরে উত্তর দেন, "জোয়ান অব আর্ক।" গীর্জার যাজকদের কাছে একটি ক্রুশ চান তারপর। যাজকরা তেমন কিছুই করেনি। একজন চাষী ছোট একটি ক্রুশ তার পোশাকে ঝুলিয়ে দেন। এরপর আর ইংরেজরা ফ্রান্সের মাটিতে তাদের দখল ধরে রাখতে পারেনি। 

 

জোয়ানকে হত্যার ঠিক ১৫ বছর পর পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাসের নেতৃত্বে গঠিত এক আদালতে জোয়ানকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। মূলত নারীদের সোচ্চার হয়ে ওঠা কিংবা তাদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রেরণা নষ্ট করতেই অমন প্রহসনমূলক রায় দেয়া হয়।

 

18

 

জোয়ান অব আর্ক আজ ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল নাম। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য সিনেমা, ডকুমেন্টারি। লেখা হয়েছে অনেক বই। প্রেরণা জুগিয়েছেন সমগ্র বিশ্বের অসংখ্য নারীকে। শুধু নারীই নয়, একটি সমগ্র জাতির আশার প্রতীক, স্বাধীনতার একাগ্রচিত্ত বীর হিসেবে তাঁর আবেদনকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি কেউ। জোয়ান অব আর্ক ঠিক অলীক মানুষ নয়, একদম স্পষ্ট ইতিহাসের চিত্র।   

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ