Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান?

রক্তের রঙ লাল। কিন্তু স্যানিটারি ন্যাপকিন যে রক্ত শোষণ করে সেটা নীল। অন্তত বিজ্ঞাপন দাতাদের মতে পিরিয়ড এর রঙ "নীল"।  বাস্তবে কিন্তু নীল রঙ এর রক্তে সন্তান ধারণ করা সম্ভব নয়। এটা কেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের পানি শোষণ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

 

পিরিয়ড এবং নারীস্বাস্থ্য একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এই পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব কেবল রক্তপাত নয়। এর সাথে জড়িত রয়েছে প্রজন্ম ধরে রাখার সম্পর্ক, জড়িত আছে নারীর সন্তান ধারণ করে পরবর্তী প্রজন্ম কে পৃথিবীর আলো দেখানোর ক্ষমতা। কিন্তু সর্বোপরি রক্ত নিয়ে যে মানব জীবনের সূচনার ধারা বজায় রাখার একটা প্রক্রিয়া চলছে সেটা আদতে একটা গৌরব চিহ্নই হওয়ার কথা। তবে সে রক্তচিহ্ন নিয়েই কেন এখনো এত রাগ-ঢাক? কেনো এত ঘৃণা? কেনো রজঃচক্র এখনো অপবিত্র বলে বিবেচিত? পিরিয়ডের রক্ত আমাদের নাড়ির সাথে নাড়ির যোগসূত্র স্থাপন করে।  

 

একজন কন্যাশিশুর নারী হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত একমাত্র মাতৃত্বই  জীবনের সর্বোচ্চ গৌরব বলে বার বার উৎসাহিত করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুস্রাবকে একটা অচ্ছুৎ বিষয় হিসাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। নারীরা মাজারে কিংবা পিরিয়ড চলাকালীন মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না। এতে সে জায়গা নাকি অপবিত্র হয়। মাতৃত্ব বনাম পিরিয়ড নিয়ে এমন দ্বিচারিতা আর কোথায় আছে? 

 

পিরিয়ড নিয়ে বাবা আর ভাইদের কিংবা পুরুষলোকের কোনো ধারণাই নেই কোথাও কোথাও। বাড়িতেও কখনো জানতে পারে না। কারণ বাড়িতে সে কখনো তার বোন অথবা তার মাকে পিরিয়ড সম্পর্কে কথা বলতে শোনে না। রক্ত দেখা তো অনেক দূরের ব্যপার। কারণ পিরিয়ড নিয়ে খোলামেলা কথা বলাকে চরম অভদ্রতা আর পাগলের প্রলাপ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়।   

 

২০১৮ সালে পিরিয়ড, এন্ড অফ সেন্টেন্স(period, End of Sentence) নামক একটা ডকুমেন্টারি আছে। সেখানে  দেখা যায় নারীদের যখন পিরিয়ড নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে তারা লজ্জায় মাথা লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না আর ছেলেদের যখন জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তখন তারা উত্তরসরূপ বলছে পিরিয়ড একটি রোগ। যে রোগটি বেশীরভাগ সময় মেয়েদের হয়। অনেকে আবার এই শব্দটিও কখনো শোনেন নি। ডকুমেন্টারি তে নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যে তেমন কোনো ধারণা  নেই, পিরিয়ড এর সময়ের পরিচ্ছন্নতা বা প্যাডের ব্যবহারও যে পৃথিবীতে বিরাজ করে এবং সেটা নিয়ে গ্রামাঞ্চলে নারীদের কোনো ধারণাই যে নেই সেটাও দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে। 

 

শুধু মন্দির, মাজার, সামাজিকতায় আর বিভিন্ন ধর্মসভায় নয়,  বরং  বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্রেও এ পর্যন্ত পিরিয়ড এর রক্তের রঙ নিয়ে একটা ট্যাবু তৈরি করেছে।

 

যেমন স্যানিটারি প্যাডের শোষণ ক্ষমতা বোঝাতে যে তরল পদার্থটি দেখানো হয়, তার রঙ দেখানো হয় নীল।কিন্তু রক্তের রঙ তো আসলে টকটকে লাল।শোষণ ক্ষমতা যদি বোঝানোর জন্য পানির মত পাতলা সলিউশনই দেখানো হয় তাহলে সেটা উদ্দেশ্য সফল নয়। কারণ রক্ত অপেক্ষাকৃত ঘন। এছাড়াও রক্ত কে নীল রঙ দেখানোতে দর্শক পিরিয়ড এর সাথে সাথে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। সে বুঝতে পারে না পিরিয়ড এর তীব্রতা কতটুকু আর স্বাভাবিকতাই বা কতটুকু। 

 

সম্প্রতি "রিয়ো প্যাড"একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছে যেখানে সকল বিজ্ঞাপনের মত টেস্টটিউবে রক্তের রঙ নীল না হয়ে হবে লাল। এপর্যন্ত যতগুলো রিয়ো প্যাড বিজ্ঞাপনচিত্র  তৈরি করেছে তাতে রক্তের রঙ ছিলো একদম রক্তের মত লাল। সেখানে মাসিকের সময় রক্তের যে অধিকমাত্রায় প্রবাহ বা ফ্লো থাকে সেটা নিয়েও বেশ সরাসরি  প্রদর্শন করা হয়েছে। 

 

যদিও এখানে মূল উদ্দেশ্যটা পিসিওডি(PCOD)মেনোপজ এবং পিসিওএস(PCOS) যে নারীদের আছে তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বানানো।কারণ এই নারীদের রক্তের যে প্রবাহ থাকে সেটা স্বাভাবিক এর তুলনায় অকল্পনীয় রকমের বেশী৷ আর স্বভাবতই পিরিয়ডের সময় যে পরিমাণ রক্তক্ষরণ হয় সেটা কর্মাসিয়ালে দেখানো একটা টেস্টটিউবের সমপরিমাণ নয়। এর পরিমাণ সাধারণত ৫০ থেকে  ৮০ মিলি লিটার পর্যন্ত হয় তবে পিসিওএস, মেনোপজের ক্ষেত্রে সেটা দ্বিগুণ থেকে চারগুণ হয়।

 

এবং রাধিকা আপ্তে(ব্র্যান্ড এম্বাসেডর) এ সম্পর্কে বলছেন, " রক্তের আসল রঙ দেখানোতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না, দেশের অর্ধেক জনগণ প্রতিমাসে এরচেয়ে বেশী রক্তক্ষরণ সামলেই চলে। যদি কখনো কেউ  কোথাও রক্তের দাগ লেগে থাকতে দেখে তাহলে এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমি খুবই আশ্বস্ত যে রিয়ো এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছে।" 

 

স্যানিটারি প্যাড এর বিজ্ঞাপনে রক্তের রঙ নীল হওয়ার কারণে একটা বড় সমস্যা হলো, নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য  তো দূরের কথা মাসিক নিয়েই পুরুষদের ধারণা অনেক অনেক কম। তাঁরা জানেনা পিরিয়ড স্বাস্থ্য ব্যপার টা কেবল শারীরিক নয় বরং মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে অনেক বেশী জড়িত। কারণ পিরিয়ড এর ফলে যে হরমোন এর উঠানামা হয় তার কারণে মুড সুইং হতে পারে, শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে, মেন্টাল ব্রেকডাউন হতে পারে, মেজাজ খিটখিটেও হতে পারে।এ বিষয়টি অনেকেই বোঝে না বলে অনেক সময়ই তারা মেয়েদেরকে এটেনশন সিকার, ন্যাকা, নখরাবাজ ইত্যাদি ইত্যাদি তকমা দিয়ে থাকে।

 

অনেকে পিরিয়ডের রক্ত শুনলেই ছি ছি করে। তাদের কাছে রক্ত অনেক বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার। রক্ত দেখলে তাদের গা ঘিন ঘিন করে৷ কিন্তু এই গা ঘিন ঘিন করা রক্ত পুঞ্জিভূত হয়ে যে এক সময় তার জন্ম হয়েছে সেটা তারা ভুলে যায়। বিষয় টা এমন না যে পিরিয়ড নিয়ে অতি জ্ঞান ধারণ করতে গিয়ে তাকে রক্ত স্নান করতে আহবান করা হচ্ছে।  বিষয় টা হচ্ছে, কেউ তার জন্মের উৎস নিয়ে জানে না কিন্তু লাইন ধরে মগজহীন কিছু প্রাণীর মত ঠিকই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছে।

 

বিজ্ঞাপন চিত্রে রক্তের আসল রঙ দেখানো হয়না কারণ মানুষ টেলিভিশনে রক্তের রঙ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবে না। মানুষ কি রক্ত কখনো দেখেনি?  একজন নারীকে যখন প্রতিমাসে ৩-৭ দিন লাগাতার রক্তপাত দেখতে হয় আর অসহ্য ব্যথা নিয়ে দিন পার করতে হয় তখন তারা কিভাবে পারে? একটা পরিবারে একজন নারী নিভৃতে বসে ব্যথা সহ্য করে যাবে আর পরিবারের কাউকে বলবে না। কোনো বন্ধুবান্ধব কে জানাবে না। কারণ জানানোটা অশালীন হিসাবে বিবেচিত হবে। এ কেমন হৃদয়বিদারক নিয়ম? 
 
পিরিয়ড সংক্রান্ত অনেক ট্যাবু এখনো পিছু ছাড়েনি। দিন যাওয়ার সাথে সাথে, পিরিয়ড সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান জনসম্মুখে বেশী বেশী নিয়ে আসতে হবে। সামাজিক অস্পষ্টতা ভাঙতে হবে৷ সেটা যদি পারা যায়, তাহলে নারী-পুরুষের একটা পারস্পরিক সহমর্মি সম্পর্ক হবে বলে আশা করা যায়। কারণ নারী পুরুষের নাগরিক অধিকার এবং মৌলিক অধিকার হবে সমান। তবে স্বাস্থ্যের দিক থেকে মানুষ ভেদে ভিন্ন থাকবে এটাই স্বাভাবিক।  

 

এই স্বাভাবিকতার সাথে খাপ খাওয়ানোটা একটা মানবিক গুণ। কিন্তু নারী পুরুষের একটা লিঙ্গ বৈষম্য বিরাজমান হওয়ার কারণে অনেক সময়ই পারস্পরিক বিরোধী আচরণ ত্বরিত হয়। তবে দিন শেষে এ আচরণ আদৌ ফলপ্রসূ কিনা সেটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে।
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ