অনন্যা’য় অনন্যা ও সামাজিক সম্পৃক্ততা
বাংলার অনন্যাদের নিয়ে জাতিগতভাবে আমাদের চিন্তা ও ভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখতে আপনি কি করবেন? বাংলার অনন্যাদের নিজেদের অধিকার ও মতামত জানানোর মঞ্চ কোথায়? এই দুই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আমাদের জন্য খুব জরুরি। কারণ, আপনি নারীর অধিকার কিংবা আজকের নারীর জন্য আগামীর অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাববেন, কিন্তু তাদেরকে কথা বলার, মুক্ত চিন্তার জায়গা করে দিবেন না; তা হয় না।
আপনি যদি বাংলাদেশের প্রতিদিনের পত্রিকা পড়েন, কিংবা টিভি চ্যানেলের নিউজ দেখেন; তাহলে নারীর দুইটি মিডিয়া রূপ সচরাচর দেখতে পাবেন। একটি 'নারী সহিংসতা'র, আরেকটি 'নারীর সফলতা'র। দুইটি বিষয়ই আমাদের সমাজে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নিগৃহীত থাকে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারী সহিংসতা প্রতিরোধের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আবহ সৃষ্টি হলেও, নারীর সফলতা এবং নারীর কথনকে যথাযোগ্য মূল্যায়নে আমাদের কার্পণ্যের শেষ নাই।
বাংলার নারীকে বাংলার পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূলে সমঅধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে যে কয়টি শক্তিশালী মিডিয়া মঞ্চের কথা আপনি খুঁজে পাবেন, তার মধ্যে পাক্ষিক অনন্যা'র নাম আপনাকে প্রথমেই শুনতে হবে। মনে রাখাটা জরুরি যে, অনন্যা'র জন্মই হয়েছে নারী পত্রিকা হিসেবে। সেটাও আজ থেকে ৩৪ বছর আগের ইতিহাস। আর নারীর অধিকার এবং নারীর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ কৃষি, বাণিজ্য, অর্থনীতি, সমাজসেবা, শিক্ষা, অভিনয়, গান, উদ্যোক্তা, রাজনীতি, সাংবাদিকতাসহ নানাবিধ কাজের জন্য প্রতিবছর দেয়া হচ্ছে 'অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার'। সেটাও ১৯৯৩ সাল থেকে।
এতো বিবরণ দেয়ার একটাই উদ্দেশ্য, আমরা নারীর অধিকারের ব্যাপারে কতটা সচেতন তার প্রতিফলন আমার-আপনার সামনেই থাকে অনন্যা'য়। অথচ নারীর অধিকার বাস্তবায়নে অনন্যা'কে এগিয়ে চলতে হয় রীতিমতো একাই। সামাজিক সম্পৃক্ততার হিসাব করলে 'আদালতে আসার আগে মিন্নির মুরগি দিয়ে ভাত খাওয়া'র সংবাদ যতটা হাস্যরসের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবহ সৃষ্টি করে, কিংবা এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী নারীর মৌলিকতা নিয়ে যেভাবে তুলোধুনো চলে; ততটা কি আমাদের 'অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার' বিজয়ী নারীরা পায়?
তাই বলে, অপরাধের স্বপক্ষের উকিল আমরা নই। কিন্তু আপনারই দেশের, আপনারই সমাজের উন্নয়নে যাদের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তাদেরকে আপনি মাথায় নিয়ে নাচতে পারবেন না, অপরাপর ঘটনার মিন্নিসহ বিচ্ছিন্ন ঘটনায় দেশ মাথায় তুলবেন; এ আপনার কেমন হঠকারিতা! দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের স্পিকার, অপর আরো প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধানসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর জয়-জয়কার। খাতা-কলমে নারীর অধিকারকে সমুন্নত রাখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। এসব কিছুকেই অনর্থক প্রমাণ করে দেয়, নারীর সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতা আর নারীর অধিকারে একই সুরে গান গাওয়া পুরুষ সমাজের অসম্পৃক্ততা দেখলে।
মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১৯ অনুসারে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৩৭ শতাংশ সন্ধ্যার পর একা চলাফেরার ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করে না। ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের অর্ধেকের বেশির বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই। প্রায় ২৪ শতাংশ নারী অপরিণত বয়সে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে।
এছাড়া এদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর একজন (২৫.৪ শতাংশ) নিম্নোক্ত পরিস্থিতিগুলোর যেকোনো একটি তৈরি হলে স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে প্রহার করা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন: (১) স্বামীকে কিছু না জানিয়ে ঘরের বাইরে গেলে, (২) সন্তানদের প্রতি অবহেলা করলে, (৩) স্বামীর সাথে তর্ক করলে, (৪) স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানালে এবং (৫) খাবার পুড়িয়ে ফেললে।
নারীর সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার সুনির্দিষ্ট জরিপ যেমনটা কঠিন, এমআইসিএস-এর এই জরিপ দেখে নারীর বর্তমান সমাজে নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে টিকে থাকার ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ প্রতিকূলতার শিকার হয়, তার ধারণা পাওয়া সহজ। বাংলাদেশ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে কমপক্ষে ২৩৫ জন নারীকে তাদের স্বামী বা স্বামীর পরিবার হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, এই কোভিডে গৃহবন্দী অবস্থাতে নারীর প্রতি সহিংসতা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে এই সামাজিক অবস্থায় নারীর জীবনযাপন, আর পাক্ষিক অনন্যা'র নারীর অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টাকে এখন তুলনা করা যায়। যাদের কাছে নারীর অধিকার এখনো শুধু খাতা-কলমেই সীমাবদ্ধ, সে জাতির সাথে পাক্ষিক 'অনন্যা' এখনো স্বগর্বে কলমের প্রতিবাদ করে যায়, একার লড়াই চালিয়ে যায়, এটা আশানুরূপ এবং সত্যিকারভাবে সাহসিকতার ও দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দেয়।
নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত মাল্টি-সেক্টরাল প্রোগ্রামের দেওয়া তথ্য অনুসারে, নারী ও মেয়েদের জন্য সরকারের নয়টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কোন একটির মাধ্যমে আইনি মামলা দায়ের করা ১১,০০০ এরও বেশি নারীর মধ্যে কেবল ১৬০ টি ঘটনায় সফলভাবে দণ্ডাদেশ এসেছে— যা প্রায় এক শতাংশ। সরকারের প্রচেষ্টার বহুলভাবে চিত্রায়িত হলেও, শুধুমাত্র আইনি জটিলতার কাছে আমাদের নারীর অধিকার হেরে যায়। নারীর ক্ষমতায়নেও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যখন ব্যর্থ আমরা, তখন সচেতন নাগরিকদের নিরাশা সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয়।
আর এইভাবেই জাতিগতভাবে হেরে যায় আমাদের শিক্ষা, হেরে যায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনা, প্রতি মুহূর্তে হেরে যায় আমাদের 'অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার' জিতে যাওয়া নারীরা। হেরে যায় শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে।