অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণ ও চিকিৎসা
১২ বছর বয়স থেকে শুরু করে ৫০ বছর অবধি একজন নারীর প্রজনন-কাল। অর্থাৎ সন্তান ধারণের জন্য তার শরীরে এই সময়ে প্রতি মাসে ডিম্বাণু তৈরি হয়। শুক্রাণুর সংস্পর্শে সেই ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে সেটা প্রতি মাসে রক্তস্রাবের মাধ্যমে নারীর শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই মাসিক চক্র বা পিরিয়ড সাইকেল হিসাব করা হয় এক চক্রের শুরুর দিন থেকে পরবর্তী চক্রের প্রথম দিন পর্যন্ত। কিন্তু নানা কারণে এই নিয়মে ছন্দপতন ঘটতে পারে বা অনেক সময় মাসের পর মাস পুরোপুরি পিরিয়ড বন্ধ থাকতে পারে।
নিয়মিত পিরিয়ড সাইকেল এর গড় সময় ২৮ দিন ধরা হয়। নারীর শরীর ভেদে, আবহাওয়া কিংবা মাসের ভিত্তিতেও এটি পরিবর্তন হতে পারে। তবে সাধারণত ২৪-৩৮ দিনের সাইকেল হলেও তাকে রেগুলার পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়। এর কম বা বেশি হলে কিংবা সাইকেল বার বার পরিবর্তন হলে তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলা হয়। নারীর শরীরে অনিয়মিত বা ইরেগ্যুলার পিরিয়ড একটি প্রচলিত সমস্যা।
অনিয়মিত পিরিয়ডের কিছু কারণ সমূহ:
বয়ঃসন্ধিকাল: বয়ঃসন্ধির শুরুতে সাধারণত ১২-২০ বছর বয়সে অনেকের শরীরে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্ট্রেরন হরমোনের অভাব থাকে, তবে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে। এছাড়াও জন্মগত ত্রুটির কারণেও পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল: বিবাহিত নারীরা হঠাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বন্ধ করে দিলে বা বার বার ওষুধ পরিবর্তন করলে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে।
পিসিওএস বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম: এটি একটি পরিচিত হরমোনের সমস্যা যা শতকরা ৮-১০ জন নারীরই আছে। এর ফলে প্রতি মাসে ওভারি থেকে ডিম্বাণু নির্গমন হয় না। এই ডিম্বাণুগুলো ওভারিতে সিস্ট তৈরি করে ওভারির চারপাশে জমা হয় এবং শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে পিরিয়ড সময় মত হয় না। কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মানসিক চাপ বা স্ট্রেস: মস্তিষ্কে রয়েছে হাইপোথ্যালামাস নামের একটি বিশেষ অংশ। যেখান থেকে প্রতিনিয়ত নিঃসরিত হয় নানা ধরনের হরমোন। এর মধ্যে কিছু হরমোন রয়েছে, যা নারীর দেহে পিরিয়ডের জন্য প্রভাবকের কাজ করে। কিন্তু অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভুগলে অনেক সময় হাইপোথ্যালামাস ঠিক মত কাজ করে না। যার ফলে পিরিয়ড শুরু হতে দেরি হয়।
ওজন কম বা বেশি: ওজনে অতিরিক্ত তারতম্য হলে পিরিয়ডের উপর প্রভাব পড়ে। অতিমাত্রায় স্থূল নারীদের ওভারির চারপাশে ফ্যাট জমে ওভুলেশন-এ সমস্যা হয়। যার ফলে পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। একই সঙ্গে আবার অতিমাত্রায় ক্ষীণ স্বাস্থ্যও পিরিয়ড অনিয়মিত করতে পারে।
থাইরয়েড'র সমস্যা: থাইরয়েড গ্ল্যান্ড যা আমাদের গলার নিচে অবস্থিত। এটি শরীরে মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি দেহের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েড গ্রন্থির যেকোনো সমস্যার কারণে আপনার মাসিক অনিয়মিত হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: অনিয়মিত পিরিয়ডের আরেকটি প্রধান কারণ হলো অসুস্থতা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। যার কারণে পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যায়।
প্রি-মেনোপজ: সাধারণত ৫০ বছর থেকে মেনোপজ বা একবারে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যেই মেনোপজ শুরু হয়ে যেতে পারে। একে প্রি-মেনোপজ বলে। এই প্রি-মেনোপজ'র সময় পিরিয়ড অনিয়মিত হয়।
ব্রেস্ট ফিডিং: ব্রেস্ট ফিডিং কে বলা হয় ন্যাচারাল কন্ট্রাসেপ্টিভ বা প্রাকৃতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যেসব মায়েরা বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের পিরিয়ড সাধারণত বন্ধ থাকে বা অনিয়মিত ভাবে হয়।
অতিরিক্ত ভারি ব্যায়াম: অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে পিরিয়ড অনিয়মিত হতে পারে বা দেরি করে হতে পারে। যারা রেসার, হেভি ওয়েট লিফটিং করেন বা অন্যান্য কারণে নিয়মিতভাবে কঠিন পরিশ্রম করেন, তারা এই সমস্যায় ভুগতে পারেন। কারণ অতিরিক্ত এক্সারসাইজ ইস্ট্রোজেন লেভেল কমায়। যার ফলে পিরিয়ড বন্ধ হতে পারে।
নিয়মিত পিরিয়ড না হলে অনেক ধরনের সমস্যা হয়। এক মাসে হলে দেখা যায় আরেক মাসে হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো দুই-তিন মাস পরপর পিরিয়ড হয়। কখনো অল্প রক্তপাত হয়, কখনো বেশি। সন্তান ধারণ ক্ষমতা হ্রাস প্রায়। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণও হতে পারে। এছাড়াও অনেক সময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে এবং অস্বস্তি বোধ তৈরি হয়।
যদি হঠাৎ করে পিরিয়ড বেশি অনিয়মিত হয়ে যায়। পর পর তিন মাস পিরিয়ড না হলে। যদি পিরিয়ড ২১ দিনের সাইকেলে হয়। পিরিয়ড সাইকেল ৩৫ দিনের বেশি হলে। যদি পিরিয়ডে অতিরিক্ত ব্যথা থাকে বা অনেক বেশি হেভি ফ্লো থাকে। পিরিয়ড এক সপ্তাহের বেশি থাকলে। যদি ৪৫ বছর বয়সের আগে পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যায় বা ৫৫ বছর বয়সের পরেও পিরিয়ড হতে থাকে।
মাঝে মাঝে পিরিয়ড অনিয়মিত হলে তাতে চিন্তার কিছু নেই। অনেক মেয়েরাই পিরিয়ড নিয়ে নানান সমস্যায় গোপনে দিনের পর দিন ভুগে যায় কিন্তু কাউকে কিছু বলে না। যার ফলে অনেক সময়ই মারাত্মক বিপদ নেমে আসে। তাই খুব বেশি অনিয়মিত পিরিয়ড হলে বা পিরিয়ড নিয়ে যেকোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হলে সাথে সাথে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।