Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাও সে তুং- এর প্রয়াণ দিবস

বিপ্লবী মাও সে তুং আধুনিক চীনের বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কমিউনিস্ট এই নেতা দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর ৪৫ বছর পরেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এই রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে এখনো আছে আলোচনা, রয়েছে বেশ কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা। অধিকাংশ সমালোচকরাই তাঁর বিপ্লবী চেতনার জন্য যতটা গুণকীর্তন করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর অদক্ষতাকেও ততটাই তুলে ধরেছেন। তাঁর আদর্শ খানিকটা জটিল; তিনি মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাদের মাধ্যমে চীনে কমিউনিজমের গোড়াপত্তন করেছেন, তবে শাসনতন্ত্র, সমরনীতি ও কূটনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে নিজস্ব দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা কমিউনিজমের নতুন ধারা মাওবাদী তত্ত্ব নামে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছে।

 

১৮৯৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চীনের হুনান প্রদেশের শাং তান জেলার শাউ শাং চুং গ্রামের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা মাও জেন শেং ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক যিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করে প্রচুর অর্থকড়ি ও জমিজমা করেন এবং কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করেন। মা ওয়েন কিমে ছিলেন সহজ-সরল ও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত ধর্মভীরু মহিলা।

 

মাও সে তুং আট বছর বয়সে তাঁর গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন। এরপর প্রায় পাঁচ বছর কনফুসীয় মতবাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। চীনে তখন চলছিল কিং রাজবংশের খুবই দুর্দশাগ্রস্থ শাসন। জনগণের জীবনযাপন তখন ছিল খুব করুণ। তবে মাও পরিবার অন্যান্যদের চেয়ে স্বচ্ছল ছিল। তবু মাত্র ১৩ বছর বয়সে আর্থিকভাবে পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে পড়াশোনা ছেড়ে মাও শুরু করেন কৃষিকাজ। বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তিনি বেশ কয়েকটি স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এমনকি বাড়ি থেকেও অনেকবার পালিয়ে যান।

 

মাও পুনরায় লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন, তবে সে সময় চীনের কিং রাজবংশের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু হয়। সেই সাথে মাওয়ের মনেও বিপ্লবীর বীজ মাথা উঁকি দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব মাও সে তুং-এর চিন্তা-ভাবনাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে। ১৯১৮ সালে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করলেও মা'কে হারিয়ে তাঁর বাড়ি ফেরার আগ্রহ হারিয়ে যায়। তাই পাড়ি জমান বেইজিংয়ের পথে। সেখানে তিনি একজন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সফলভাবে কমিউনিজমের চর্চার প্রতিফলন দেখালে তিনি অনুপ্রানিত হয়ে কার্ল মার্ক্সের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর অনুবাদও পড়ে ফেলেন এবং বছর কয়েক পড়াশোনার পর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনী সদস্যদের একজন হিসেবে যোগদান করেন।

 

মাওয়ের কমিউনিস্ট পার্টি বছরের ব্যবধানেই ব্যাপক শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হতে শুরু করলে ১৯২৩ সালের দিকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল কুওমিনট্যাং তথা চীনের প্রেসিডেন্ট সান ইয়াৎ-সেন কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করেন। যার ফলে রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিকে মাও কমিউনিস্ট পার্টি ও কুওমিনট্যাং পার্টি দুই দলকে সমর্থন করলেও, পরবর্তীতে তিনি লেনিনীয় মতবাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আর এই জন্য তিনি চীনের নির্যাতিত কৃষকদেরকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। তাদের মাঝে নিজের বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার বীজ রোপন করে দেন।

 

১৯২৭ সালের দিকে চীনের ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে চুক্তি ছিন্ন করে আগ্রাসী হয়ে উঠে। প্রায় ৫ হাজার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। দেশজুড়ে রক্তের মাতম লেগে যায়। আর এখান থেকেই শুরু হয় চীনের গৃহযুদ্ধ। মাও তাঁর অনুসারী কৃষকদের একত্রিত করে কুওমিনট্যাং পার্টির বিরোধী সৈন্যদল গড়ে তোলেন, কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেক প্রায় নব্বই শতাংশ কৃষকদের হত্যা করে মাওয়ের আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয় এবং বেইজিং দখল করে নেয়। ফলে, বিশ্ববাসীর কাছে কুওমিনট্যাংই চীনের ক্ষমতাসীন দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

 

এদিকে, মাও সে তুং পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে লেনিন মতবাদ থেকে বেরিয়ে তাঁর নিজস্ব মতবাদ 'মাওবাদী মতবাদ' স্থাপনের ব্যাপারে জোরদার হোন। তিনি দক্ষিণ হুনান ও জিয়ানজি প্রদেশে কৃষক সেনাদের নিয়ে নিজের বাহিনী শক্তিশালী করতে থাকেন। এর মধ্যেই খবর আসে চাংশায় ক্ষমতাসীন দলের একজন সেনাপতি মাওয়ের স্ত্রী ও আট বছরের সন্তানকে আটক করে। কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁর আট বছরের সন্তানের সামনে মা কে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর মাও হয়ে উঠেন আগ্রাসী ও তাঁর পদক্ষেপ দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে।

 

তিনি পার্বত্য অঞ্চলে তাঁর গেরিলা সৈন্যদের নিয়ে রেড আর্মি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার। তাদের উন্নত মানের অস্ত্র ছিল না, কিন্তু তারা ছিল বেশ উগ্র। মাও সোভিয়েত রিপাবলিক অব চায়না সরকার গঠনের ঘোষনা দেন। মাও-এর গেরিলা সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হয় দলের নীতিমালার সাথে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাদের নির্যাতন করে মেরে ফেলার জন্য। মাও স্থানীয় জমিদারদের আটক ও হত্যা করার নির্দেশ দেন। এসময় আনুমানিক দুই লক্ষ জমিদারকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। মূলত, তৎকালীন শাসকরা যে ভয় দেখিয়ে শাসন ধরে রাখতে চাইছিল, মাও তার ঠিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া দিয়েই তাদের সোজা করতে চাইছিল। সরকার দলের সৈন্যদের মনে আতংক সৃষ্টি করার প্রয়াস চালানো হয়।

 

সত্যিকার অর্থেই প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেক কমিউনিস্টদের সাফল্য দেখে ঘাবড়ে যায়। এবং জিয়াংজি প্রদেশে কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করতে ১০ লক্ষ সৈন্য পাঠানো হয়। ১০ লক্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্রের সৈন্যের বিরুদ্ধে ৮৫ হাজার দেশীয় অস্ত্রবাহী সৈন্যের যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত দেখে মাও সে তুং এ যাত্রায় তার রেড আর্মি বা লাল বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যান।

 

মাও তাঁর রেড আর্মি সেনা ও কমিউনিস্ট সমর্থকদের নিয়ে জিয়াংজি থেকে শানঝি প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার হেঁটে আসেন। একে বলা হয় ‘দ্য লং মার্চ’। বৈরী আবহাওয়া, বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তা, সেতু ছাড়া নদী পার হওয়া, স্থানীয় কুওমিনট্যাং সেনাদের আক্রমণ এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে মাত্র সাত হাজার কমিউনিস্ট সদস্য শেষ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তবে, চীনের কাছে মাও সে তুং এ ঘটনার পর  হয়ে উঠেন অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা। এমন সাহসী, সুদৃঢ় শক্তিশালী মানসিকতার জন্য চীনের সাধারণ জনগণের মাঝে মাওবাদী চিন্তা-চেতনার প্রাধান্য পায়, বিশেষ করে চীনে জাপানের আক্রমণের পর থেকে এই ভাবনা আরো জোড়ালো হয়। 

 

তাই বাধ্য হয়ে জাপানের আক্রমণ হতে নিজেদের রক্ষার জন্য চিয়াং কাই-শেক কমিউনিস্টদের সন্ধি করেন এবং মাও সে তুং জাপানের সাথে যুদ্ধে চীনের মিত্রবাহিনীর সামরিক নেতা হিসেবে কাজ করেন। চিয়াং কাই-শেকের অধিক সৈন্যের তুলনায় মাও-য়ের গেরিলা সৈন্যরাই শক্তিশালী জাপানের বিরুদ্ধে অধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখে। যার জন্য যুদ্ধ ১৯৪৫ সাল অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত চলমান থাকে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে আবারো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এসময় মাও সে তুং এর রেড আর্মি বা লাল বাহিনী পরিচিতি পায় পিপলস লিবারেশন আর্মি নামে। ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুং বেইজিংয়ের তিয়ান আনমেন চত্বরে পিপল’স রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দেন। এবং চিয়ান কাই-শেকের সৈন্যদলের পরাজয়ের মাধ্যমে মাও সে তুং এর সমগ্র চীনের অধিপত্য নিশ্চিত হয়। তারপর থেকে শুরু হয় মাও সে তুং এর শাসনামল । 

 

বলা হয়ে থাকে, মাও তাঁর শাসনামলের শুরুতেই প্রায় ২০ থেকে ৫০ লক্ষের মতো জমিদার শ্রেনীর বা পুঁজিবাদী বিশ্বাসী মানুষকে হত্যা করার নির্দেশ দেন এবং তাদের সম্পদ কৃষকদের মাঝে বিলিয়ে দেন। এছাড়া বিরোধীদলের প্রায় ৮ লক্ষ লোক বিভিন্ন সময় মাওয়ের আর্মি দ্বারা হত্যার শিকার হোন। একই সাথে, তিনি সমাজতান্ত্রিক ধারায় ১৯৫৩-৫৮ সালের মধ্যে চীনকে একটি শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেন, যার ফলস্বরূপ বহু কৃষককে জোরপূর্বক লোহার কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করে তার সরকার। এর ফলাফল হয়ে দাঁড়ায় ভয়াবহ। ১৯৫৮ থেকে ৬০ সাল পর্যন্ত চীনে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়।

 

এতো কিছুর পর অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতারা, বিশেষ করে লিউ শাও চি ও ডেং জিয়াওপিং এর নেতৃত্বে একটি সম্মেলনে ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পদচ্যুত করা হয়। মাও সে তুং তখন শুধু চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারতেন, যতদিন না তাঁকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকেও সরিয়ে দেয়া হয় এবং একটি মধ্যমপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারায় চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থা কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা পরিচালনা করে।

 

মাও এরপর লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন, তাঁর বেশ কিছু বই সে সময় ব্যাপক সাড়া ফালায়। তিনি সেই সময়ের চীনা তরুণদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দেন এবং অবিশ্বাস্যভাবে তাঁর সে ডাকে সমগ্র চীনের তরুণরা সাড়া দেয়। তাঁর অনুসারী তরুণরা পুনরায় 'লাল বাহিনী গঠন করে নতুনত্ত্বের আশায় পুরনো চীনের সকল সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিগড় ভেঙে ফেলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তারা পুঁজিবাদী মনোভাব পোষন করে এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে হত্যা করে এবং মাও এর বিরোধী কমিউনিস্ট নেতারাও এই বাহিনী দ্বারা পিষ্ট হয়। ১৯৭৬ সাল, মাওয়ের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলতে থাকে, যদিও অনেক আগেই এই আন্দোলনের ইতি টানার ঘোষনা দেন তিনি।

 

১৯৭৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বরে মাও সে তুং মারা গেলেও তাঁর মাওবাদী আদর্শ একাবিংশ শতাব্দীতে বলবৎ আছে। নেপালে ও চীনের বেশ কিছু অঞ্চলে মাওবাদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তরুণরা আন্দোলন সংঘটিত করে। যদিও বলা হয়ে থাকে, মাও হিটলার ও স্টালিনের সম্মিলিত হত্যা সংখ্যার চেয়েও বেশি নিজ দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তবে, চীনের সেই সমসাময়িক হত্যা ও লুন্ঠনের রাজনীতিতে মাও সে তুং গণমানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর বিপ্লবের মাধ্যমে। আর তাই, আজও বহুদেশে আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক কমরেড মাও সে তুং বিপ্লবীদের বীজ রোপনকারী হিসেবে বিবেচিত হোন। যেখানেই রক্তের বিনিময়ে বিপ্লবীদের স্বাধীনতা কথা বলবে, সেখানেই মাওবাদীদের চিন্তা-চেতনার ছাপ পাওয়া যায় আজও।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ