Skip to content

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ লিও তলস্তয়ের জন্মদিন

লিও তলস্তয়, যিনি ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার-এর জন্য একাধিকবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং ১৯০১, ১৯০২ এবং ১৯১০ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার-এর জন্য মনোনীত হন এবং তাঁর পুরস্কার না পাওয়ার ঘটনাটি বিশ্বজুড়ে নোবেল পুরস্কারের কমিটিকে বিতর্কিত করে তোলে। কতটা শক্তিশালী সাহিত্য স্রষ্টা হলে পুরো বিশ্বের পাঠককে তাঁর কলমের লেখায় বন্দী করা যায়, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট হয়। বিখ্যাত এই রুশ লেখক যতটা প্রভাবশালী তাঁর সাহিত্যকর্মে, শেষজীবনে তিনি ততটাই সাদাসিধা জীবনযাপন করেছেন, মিশেছেন সাধারণ মানুষের সাথে। আজ ৯ই সেপ্টেম্বর, এই মহান লেখকের জন্মদিন যাকে রুশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

লিও তলস্তয় ১৮২৮ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর রুশ সাম্রাজ্যের তুলা প্রদেশের ইয়াস্নায়া পলিয়ানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু বয়সে তাঁর বাবা-মা মারা যান এবং আত্মীয়স্বজনদের দ্বারাই লালিত-পালিত হোন তিনি। তলস্তয় রাশিয়ান প্রাচীন সুপরিচিত অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিছু গবেষণা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে তলস্তয় পরিবার লিথুয়ানিয়া থেকে আগত; যারা লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডাচি'র অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে ছিলো। তিনি উপন্যাস ছাড়াও নাটক, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনায় ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। 

 

লিও তলস্তয় তরুণ বয়সে শান্ত-শিষ্ট ছিলেন না; ছিলেন খামখেয়ালি, বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত। পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিলেন জমিদারি। টাকা উড়িয়েছেন দুই হাতে। বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়ায় সমস্যা থাকায় অধিকাংশ সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী পড়ে জানতে পারেন, বেঞ্জামিন তাঁর সকল দোষগুলো দিন শেষে ডায়রিতে লিখে রাখতেন। তিনিও তাই করেছেন এবং ডায়রি তুলে দিয়েছেন স্ত্রীর হাতে। সেই ডায়রি পড়ে স্ত্রী তাকে 'চরিত্রহীন' বলেও পরবর্তীতে অভিহিত করেছেন। এমন দস্যিপনাতেই তাঁর তরুণ বয়স কেটেছে। এসময় তাঁর ভাই তাঁকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করায়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি বিচলিত হোন। দেশে ফিরে পুরোপুরি লেখায় মনোনিবেশ করলেন।

 

তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ ও তৎকালীন রুশ জার-শাসনের সমালোচনা করে লিখতে শুরু করলেন। তাঁর লেখার ধার এতই মারাত্মক ছিল যে রুশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিতেও সমীহ করতো। তাঁর লেখায় তাই উঠে আসতে থাকে সরকারের উদাসীনতা আর আইনের নামের প্রহসনের বিভিন্ন চিত্র। তাঁর সাথে আস্তে আস্তে সাধারণ কাতারের মানুষের সখ্যতা বাড়তে থাকে । সাধারণ শ্রেণির মানুষ তাঁকে সম্মানের পাত্রে বসায়। এরপর তিনি লিখতে শুরু করলেন ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে। ফলস্বরূপ, যাজক-গোষ্ঠী তাকে খ্রিস্টান ধর্ম থেকে বিতাড়িত ঘোষণা করলেন। তবুও সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় লিও তলস্তয়ের জায়গার কোনো ভাটা পড়লো না। 

 

এসব কিছুর পরেই তিনি লিখলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'ওয়্যার এন্ড পিস'। বইটি ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৭ সালে ধারাবাহিকভাবে ও ১৮৬৯ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট-এর রুশ অভিযান। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং শান্তির জন্য মানুষের সংগ্রামই এই উপন্যাসের মূল বক্তব্য। তলস্তয় ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি লাতিন, ইংরেজি, আরবি, তুর্কো-তাতার, ইতালীয়, গ্রিক এবং হিব্রু ভাষা জানতেন। তিনি সংগীতশাস্ত্র এবং চিত্রাঙ্কন বিদ্যাতেও মোটামুটি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর একাগ্রতা ও পরিশ্রম করবার শক্তি ছিল অসাধারণ। তিনি মেধাবীও ছিলেন। ভালো শিকারি ছিলেন এবং ভয়ংকর একগুয়ে স্বভাবের ছিলেন। একবার ভালুক শিকারে গিয়েছিলেন, একটা ভালুক থাবা মেরে চোখের নিচে থেকে বাঁদিকের গাল ছিড়ে নামিয়ে দেয়; দুই সপ্তাহ পরে ভালো হয়ে তিনি ফের শিকারে যান এবং ঐ ভালুকটিকে বধ করেন। এরকম প্রচণ্ড জীবনীশক্তিতে ভরপুর ছিলেন তিনি।

 

একবার রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ হল। আক্রান্ত অঞ্চল সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতে লাগলেন তলস্তয়। সেই সময়ের একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা তাঁর মনকে আলোড়িত করে। একটি মেয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে; আর সেই ঘটনাকে নিয়ে লিখলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘আন্না কারেনিনা’। 'আন্না কারেনিনা' ১৮৭৮ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিতে তৎকালীন সময়ের বাস্তবিকতা এবং পারিবারিক জীবনের ব্যক্তিগত অবস্থার কথাও প্রকাশ পেয়েছে। 

 

লিও তলস্তয় তাঁর সাংসারিক জীবন নিয়ে মোটেও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নি। তাঁর লেখায় সেই কথা স্পষ্ট। তিনি তাঁর স্ত্রীর নামে সব কিছু উইল করে দিয়ে গ্রামে চলে যান এবং সেখানে স্কুল ঘর দিয়ে গ্রামের বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নেন। এসময়ই তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের আরো কাছাকাছি মিশেছেন, দেখেছেন তাদের জীবন আর দুমুঠো ভরে লিখে গেছেন। লিখলেন 'ক্রয়োজার সোনাটা' যেখানে এক বৃদ্ধের মানসিক যন্ত্রণার কথা চিত্রায়ন করা হয়। ধারণা করা হয়, লেখাটি  তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই লেখা। 

 

তলস্তয়  তাঁর আত্মজীবনীও লিখে গেছেন। ট্রিলোজি এই জীবনীর প্রথম প্রকাশ ১৮৫২ সালে 'চাইল্ডহুড' এবং ১৮৫২-৫৬ সালের মধ্যে লিখেছেন 'বয়হুড' ও 'ইয়ুথ'। ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর রাশিয়ার আস্তাপভা নামক এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের রেলওয়ে স্টেশনে তলস্তয় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯২৮ ও ১৯৫৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম ৯০ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত হয়।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ