Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শামসিয়া হাসানির গ্রাফিতি যেন আফগান নারীদের প্রতিচ্ছবি

আফগানিস্তানের প্রথম নারী দেয়াল চিত্রশিল্পী বা গ্রাফিতি শিল্পী শামসিয়া হাসানি তার গ্রাফিতির মাধ্যমে তালেবান শাসনে নারীদের শোচনীয় অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছেন। বিপদ জেনেও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে রঙ, তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন আফগানিস্তানের দেয়াল।

 

চিত্রশিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে বিগত কয়েক বছরে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তানের প্রথম নারী গ্রাফিতি শিল্পী ও নারীদের জন্য সোচ্চারকন্ঠী এই নারী এশিয়াসহ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের চিত্র প্রদর্শনীতে সম্মানের সহিত অংশ নিয়েছেন। 

 

২০১৪ সালে ফরেন পলিসি পত্রিকার বিশ্বের ১০০ শীর্ষ চিন্তাবিদদের তালিকায় উঠে আসে আফগান এই খ্যাতনামা শিল্পীর নাম৷ এছাড়াও ‘Goodnight Stories for Rebel Girls’ নামক অন্যতম সর্বাধিক পঠিত একটি বইয়ের দ্বিতীয় ভলিউমে তার কথা বলা হয়েছে। এই বইয়ের সিরিজে সংগ্রামী ও সাহসী নারীদের কথা বলা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত এই বইটি।

 

একের পর এক এলাকা দখলের পর পুরো আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা তালেবান গোষ্ঠীর হাতে উঠে আসার পর নতুন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হন শামসিয়া হাসানি৷ অল্প সময়েই ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শামসিয়ার দুটি দেওয়াল চিত্রের ছবি৷ তার আঁকা এই দুই গ্রাফিতি আফগানিস্তানে নারীদের সংকটাপন্ন অবস্থা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। 

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা শামসিয়ার প্রতিটি ছবি দেখলেই বোঝা যায় তাঁর অর্থ। আপাতদৃষ্টিতে প্রায় প্রত্যেকেরই সেই অর্থ বোধগম্য হলেও তার গভীরতা অতল। সেসব ছবিতে আছে কট্টর মৌলবাদী ইসলামী দল তালেবানের শাসনে ফেরার আতঙ্ক, ভবিষ্যৎ নিয়ে আফগান নারীদের দুশ্চিন্তার ছায়া। ১০ অগাস্ট দুঃস্বপ্ন নামে একটি ছবি প্রকাশ করেন এই গ্রাফিতি শিল্পী। সেখানে তিনি এঁকেছেন সর্বাঙ্গ বোরকায় ঢাকা এক নারীর ছবি, যে দুই হাতে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আড়াল করে রেখেছে তার প্রিয় পিয়ানো। তার পেছনেই দেখা যাচ্ছে অস্ত্রধারী তালেবান যোদ্ধাদের সারি সারি ছায়াচ্ছন্ন মুখ। 

 

পরবর্তীতে তালেবান বাহিনী কাবুলে প্রবেশ করলে তিনি আঁকেন আরেক গ্রাফিতি, যেখানে আকাশি বসনা এক মেয়ে অন্ধকারে রক্তচক্ষু এক অস্ত্রধারী তালেবান যোদ্ধার সামনে ধরে আছে আলো। শত শত অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবিগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা সকলে। হাসানির নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা জানায় তারা।

 

গত কয়েক সপ্তাহ থেকে কাবুলের পাবলিক এলাকাগুলোয় নারীদের আনাগোনা অনেক কমে গেছে। অনেক শিল্পীই তালেবান সহিংসতার ভয়ে তাদের ম্যাসেজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছেন। তালেবানদের কাবুল দখল করার পর হাসানির সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলি কয়েক দিনের জন্য একেবারে নীরব ছিল। এর ফলে তার অনেক অনুসারীরা তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। পরবর্তীতে মঙ্গলবার তার নতুন গ্রাফিতি ‘ডেথ টু ডার্কনেস’ এর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে তার নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। হাসানির ম্যানেজার জানিয়েছে যে, তিনি (হাসানি) কোন সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য এখন প্রস্তুত নয়। তবে অজ্ঞাত স্থানে তিনি নিরাপদে আছেন।

 

নারী শিল্পীদের ওপর হুমকি দ্বিগুণ

ছবি প্রকাশ করা আসলেই একটি অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। অধিকাংশ বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন যে, ৯০ এর দশকের মতোই আবার এখন তালেবানরা নারীদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং সহিংসতা প্রতিষ্ঠা করবে। এরমধ্যে নারী শিল্পীরা দ্বিগুণ বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে। কারণ তালেবানরা নারীর যেকোন সৃজনশীল কাজকে ইসলামী আইনের কঠোর লঙ্ঘন হিসেবে মনে করে। 

 

২০১৬ সালে একটি সাক্ষাৎকারে হাসারি বলেছিলেন যে, "কিছু লোক মনে করে যে ইসলামে শিল্পের অনুমতি নেই এবং তারপরে তারা মনে করে যে আমাকে তাদের থামানো উচিত… অনেকগুলো ব্যক্তি যদি একসাথে কাজ করে তাহলে তারা অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তারা একত্রে সব কিছু করার সক্ষমতা রাখে। 

 

নারীদের সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন

১৯৮৮ সালে ইরানে আফগান শরণার্থীদের পরিবারে জন্ম হয় শামসিয়া হাসানি। এরপরে ২০০৫ সালে দেশে ফিরে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন৷ ২০১০ সালে গ্রাফিতি এবং স্ট্রিট আর্ট এ তিনি ডিগ্রি ডিগ্রী অর্জন করেন। আফগান নারীদের প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব ও দাবিয়ে রাখার অবস্থা সবার সামনে তুলে ধরতে গ্রাফিতির চেয়ে আর ভালো কিছু হয়না। তাই তিনি গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রকেই বেছে নেন। তিনি যখন রাস্তায় দেয়ালে গ্রাফিতি করতেন, লোকেরা তাকে গালিগালাজ করত, হুমকি দিত, বিভিন্ন রকম ভয় দেখাত। কাবুল শহরে কোন গ্যালারি নেই, নেই কোন প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও। তাই কাবুল শহরটাকেই ক্যানভাসে পরিণত করে, প্রতিনিয়ত প্রদর্শনী করে চলেছেন এই ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পী শামসিয়া।

 

তিনি আফগান নারীদের ওপর আরোপিত কড়া বিধিনিষেধ দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তারা যেমনই থাক, সম্পূর্ণ পর্দার মধ্যে থেকে বোরকার ভেতরে থেকে নিজেদেরকে আত্মপ্রকাশ করুক। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তাদের বাস্তবে আধুনিকভাবে যা আছে তার চেয়ে আরো বড় করে তাদের দেখানোর চেষ্টা করি। মানুষেরা যেন তাদের ভিন্নভাবে দেখে সেই চেষ্টা করি আমি।’ তালেবান এবং অন্যান্য চরমপন্থি গোষ্ঠীর আক্রমণের সরাসরি জবাব দেওয়ার জন্য হাসানি তার শিল্পকে ব্যবহার করেছেন। 

 

২০২০ সালের নভেম্বরে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার শোকে কম্পোজিট পেইন্ট-অন-ফটোগ্রাফ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার অধ্যাপক ছিলেন। একই বছর মে মাসে প্রসূতি ওয়ার্ডে মরণাত্মক আক্রমণের স্মরণে একটি ধূসর রঙের ছবি তৈরি করেছিলেন তিনি।

 

সে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পারে না

আকাঙ্ক্ষা-অস্বীকার, আশা ও হৃদয় ভাঙা এবং স্বাধীনতা ও ভয় নারীর আবেগের চিত্রগুলো হাসানীর সারা শরীর জুড়ে বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশ করে। অনেকগুলি ছায়া একত্রিত হয়ে ঝলমলে রঙের সাথে সাহসী ভাবে জ্যামিতিক পরিসংখ্যানের প্রবণতা রাখে তারা। মোটা, লম্বা চোখের দোররা বন্ধ চোখের উপর পড়ে কারণ হেডস্কার্ফের নীচে থেকে ফিল্ম রোলস বা মেডুসা টেন্টাকলের মতো অবাধে চুল প্রবাহিত হয়। তাদের কোন মুখ নেই এবং উপাদানগুলিতে প্রকৃতির উপাদান বা যন্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকে। তার মুখ না থাকায় সঙ্গীত যন্ত্র দিয়ে মহিলাদের জন্য ভয়েস বাজানোর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া মানুষের সাথে ভাব বিনিময়, উচ্চস্বরে কথা বলতে কিংবা মনোযোগ পেতেও এসব ব্যবহার করতে পারেন। নিজের চারপাশে দেখার মতো কিছু না থাকায় তার চোখ বন্ধ এবং সে কখনও কখনও নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না।

 

শহরটি আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীনেও কাবুলে জনসমক্ষে সৃজনশীলভাবে কাজ করা একজন নারী হিসেবে তার ঝুঁকি ছিল। গ্রাফিতির প্রকাশ্য প্রকৃতি, নিজের ভয়কে অস্বীকার করে প্রকাশ্যে কাজ করা আকৃষ্ট করেছিল হাসানিকেও এবং যাদের গ্যালারি বা যাদুঘর দেখার সুযোগ খুব কম তাদের শিল্পের সাথে পরিচয় করানোর এটি একটি ভালো উপায়। হাসানি বলেছিলেন, আমি সবসময়ই পাবলিক স্পেসে বিস্ফোরণের ভীতিতে থাকি।

 

তিনি কাবুলের রাস্তায় গ্রাফিতি করবেন যা খুব বড় নয় এবং দ্রুতই সে সরে যেতে পারে। চ্যালেঞ্জগুলো এড়ানোর জন্যই তিনি ভবনগুলোর ছবি তোলা এবং গ্রাফিতিগুলো সরাসরি স্ন্যাপশটে আঁকতে শুরু করেন, এটিই তার "ড্রিমিং গ্রাফিতি" সিরিজ।

 

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির একটি ভাষ্যে, হাসানি স্টুডিওতেও দ্রুত কাজ করেন। ফলস্বরূপ বড় আকারের ক্যানভাস থেকে শুরু করে ডলারের বিলের ক্ষুদ্র সিরিজ পর্যন্ত পাওয়া যায়। হাসানি শিল্প জগতে সাফল্য অর্জন করলেও কখনও কখনও হতাশ বোধ করেন এবং কোনও পার্থক্য করতেও অক্ষম হতেন। 

 

নিজের শিল্পের মাধ্যমে মানুষকে শক্তি দেওয়ার জন্য তিনি বলেছিলেন, "আমি মনে করি যে আমি আমার শিল্পকর্ম দিয়ে মানুষের মন পরিবর্তন করি এবং মানুষের সাথে আমার ধারণাগুলো ভাগ করি।" তিনি তার সাম্প্রতিক ছবিগুলোর মাধ্যমে আফগানিস্তানের নারী ও মেয়েদের দুর্দশা প্রকাশ করেছেন এবং তাদের ভুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছেন।

 

 

অনুবাদক: শাশ্বতী সরকার, সাজিয়া আফরিন সৃষ্টি
 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ