কোভিড টিকায় প্রজনন ক্ষমতা ও গর্ভপাতের ধারণা
অতিমারির এ সময়ে নানা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হতাশ হচ্ছে সাথে ভুল সিদ্ধান্তে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে হাজারো মানুষ। কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে যেন আতংকের শেষ ছিল না। তবে পর্যায়ক্রমেই যেন তা একটু একটু করে কালো মেঘের মত সরে যাচ্ছে। পরিচয় পাচ্ছে ভিত্তিহীন গুজব। মিলছে সঠিক তথ্য। তেমনই কোভিড-১৯ টিকা নিলে নারীর প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট এবং গর্ভপাত হতে পারে- এমন অনেক তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে রয়েছে। যদিও এসবের স্বপক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
নারীর গর্ভকালে তাকে যেকোনো পরামর্শই খুব সতর্কতার সঙ্গে দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। আসলে এই শারীরিক অবস্থায় আগে ইনজেকশন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হত। তবে নির্ভরযোগ্য অনেক তথ্য মেলায় এখন সেসব পরামর্শ অনেকটাই অচল। বরং করোনাভাইরাস অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে ওঠায় তাদেরকে টিকা নেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তাতে বেঁচে যাবে দুটি প্রাণ। সুস্থ সুন্দর থাকবে মায়ের আশার আলো।
টিকা নিলে গর্ভপাত পুরোপুরি ভিত্তিহীন দাবি। যুক্তরাজ্যের মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ) ইয়েলো কার্ড স্কিম এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন অ্যাডভার্স ইভেন্ট রিপোর্টিং সিস্টেমে কয়েকজন রোগীর গর্ভপাতের রেকর্ড দেখিয়ে এমন দাবি করা হয়।
এই দুই জায়গায় যে কেউ রিপোর্ট করতে পারে; যদিও সবাই শেষ পর্যন্ত তা করে না। আর যে কয়েকটি গর্ভপাতের অভিযোগ করা হয়েছে সেসবের কারণ টিকা নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে টিকা নেওয়ার পর গর্ভপাতের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার হার সাড়ে ১২ শতাংশ; যা অন্যসব গর্ভপাত পরিসংখ্যানের মতই।
এ নিয়ে ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের রিপ্রোডাকটিভ ইমিউনোলজিস্ট ভিক্টোরিয়া মেল বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরল টিকার এমন সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো জানার জন্য এই রিপোর্টিং পদ্ধতি খুব কাজের। আর এভাবেই অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার কয়েকটি ঘটনা নজরে আসে।
যদি টিকা নেওয়া নারীদের গর্ভপাত হওয়ার ঘটনা নিয়ে অনেক বেশি অভিযোগ জমা পড়ত তবে অবশ্যই দ্রুত এ নিয়ে তদন্ত হত। কিন্তু আমলে নেওয়ার মত বেশি সংখ্যক অভিযোগ জমা পড়েনি। তাই চিকিৎসারা মা ও শিশুর চিন্তা করে কোভিড-১৯ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
গর্ভপাতের পাশাপাশি টিকা নিলে গর্ভফুলের ক্ষতি হয় এই দাবির স্বপক্ষেও কোন প্রমাণ মেলেনি। তবে এই ভুল ধারণার সূত্রপাত হয়েছিল গবেষক মাইকেল ইয়াডনের পিটিশন থেকে। এই গবেষক কোভিড নিয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য আগেও করেছেন। মাইকেল ইয়াডন দাবি করেন, ফাইজার ও মডার্না করোনাভাইরাসের টিকায় যে প্রোটিন স্পাইক তার সঙ্গে গর্ভফুলে থাকা সিনসাইটিন-১ প্রোটিনের অনেকটা মিল রয়েছে। আর তাতে এই গবেষকের আশঙ্কা শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে তা গর্ভফুলের প্রোটিনকেই ভুলবশত আক্রমণ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, টিকা প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে তার কারণ মাইকেল ইয়াডনের এমন বক্তব্য।
আসলে সিনসাইটিন-১ ও কোভিড টিকার প্রোটিন অন্য যেকোনো প্রোটিনের মতই দেখতে। মানুষের শরীরতন্ত্র যদি এতই বিভ্রান্ত হত তবে যেকোনো সংক্রমণে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার পর শরীর এর নিজের প্রত্যঙ্গকেই বারবার আক্রমণ করত।
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্টিলিটি চিকিৎসক র্যানডি মরিস তার তত্ত্বাবধানে আইভিএফ চিকিৎসা নেওয়ার রোগীদের দিকে নজর রাখা শুরু করেছিলেন। তার জানার আগ্রহ ছিল আইভিএফ চিকিৎসায় সফল গর্ভধারণে কোভিড টিকা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিনা।
এতে টিকা নেওয়া বা না নেওয়া এবং এর আগে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন এমন ১৪৩ জন নারী ছিলেন নজরদারিতে। এদের সবারই ভ্রূণ জরায়ুতে সফলভাবে স্থাপন করা হয়েছিল।
ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নয় বরং বিজ্ঞান ভিত্তিক ও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টিকার ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি। করোনার এ অতিমারিতে হতাশা নয়, সঠিক তথ্যের সাহায্যে সকলের এব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।