Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘মেয়ে যে কালো, বিয়ে হবে তো?’

ভাবছেন তো, আপনাদের রোজকার দিনের অতি পরিচিত একটি বাক্য শিরোনাম হয়ে গেল কেন? এ বাক্য তো উঠতে বসতে হাজার বার শুনতে পান অথবা আপনিও কাউকে বলে থাকেন, অতি সাধারণ এই বাক্যটি হঠাৎ করে শিরোনামে কেন? আপনার কাছে যে বাক্যটি হয়তোবা নেহাতই তুচ্ছ মনে হচ্ছে, তা একদমই তুচ্ছ কোন বিষয় নয়। 

আজকাল 'বডিশেমিং' শব্দটি বেশ পরিচিতি পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় হরহামেশাই দেখা যায় 'বডিশেমিং' নিয়ে প্রতিবাদমূলক পোস্ট। মাঝেমধ্যে প্রতিবাদের মাত্রা একটু কমে যায় আবার মাঝেমধ্যেই কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয় নেটিজেনরা। তবে সে বিশাল আকৃতির প্রতিবাদমূলক পোস্ট দেয়া শেষ করে বন্ধুকে 'কিরে আটার বস্তা?' বলে সম্বোধন করা আমাদের কাছে অতি সাধারণ ব্যাপার।  

এইতো বেশ কয়েকদিন আগের ঘটনা। স্বাভাবিকের থেকে ওজন একটু বেশি হওয়ায় বডিশেমিং এর শিকার হয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। সামিন নামের ওই কিশোর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। অ্যানেরক্সিয়া নারভোসায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান সে। অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা একটি খাদ্য গ্রহণজনিত সমস্যা। এতে ব্যক্তির মনোজগতে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে  ভয় তৈরি হয়। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি না খেয়ে বা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খেয়ে ওজন কমাতে চান। 

যেমনটা হয়েছিল সামিন নামের সেই কিশোরের সাথে। তার এক আত্মীয়ের দেয়া ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে সামনে আসে পুরো ঘটনা। যেখান থেকে জানা যায়, ওজন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হবার কারণে স্কুলে প্রতিনিয়তই সহপাঠী, এমনকি শিক্ষকদের বুলিং ও বডি শেমিংয়ের শিকার হতে হত তাকে। যার জের ধরে তিনি জেদ করে ওজন কমানো শুরু করতে থাকেন। ইন্টারনেট দেখে শুরু করেন কিটো ডায়েট। ফলশ্রুতিতে ২০২০ সালের জুন-জুলাইতে যার ওজন ছিল ৯৩ কেজি, সেখান থেকে ডিসেম্বরেই ওজন কমে দাঁড়ায় ৬০ কেজি। 

তবে ততদিনে ওজন কমার পাশাপাশি তার শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে শুরু করে এবং মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে যায়। এরপর তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ফেব্রুয়ারিতে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা দেয়া শুরু করা হয়। কিন্তু ততদিনে তার ইমিউনিটি ও ওজন দুটোই অনেকটা কমে গেছে । 

শুধু তাই নয়, তার মানসিক স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পরেছিল। ওজন বেড়ে গেলে আবারও স্কুলে তাকে বডিশেমিং এর শিকার হতে হবে এই ভেবে তিনি খেতে ভয় পেতেন। কোন বেলায় পরিবারের চাপাচাপিতে সামান্য বেশি খেলেও পরবর্তীতে বমি করে ফেলত সে। এরপর চলতি বছর মে মাসের দিকে তার ওজন দাঁড়ায় মাত্র ২৯ কেজিতে। গত ২৬ জুন  নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।

এসব তথ্য নিয়ে তার আত্মীয়ের দেয়া ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় সে পোস্টটি। হাজার হাজার কমেন্ট আর শেয়ার করে মানুষ বডিশেমিং নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। সারাদিন পাশের বাসার মেয়েটিকে, 'কালো, বিয়ে হবে না' বলা আন্টি থেকে শুরু করে বন্ধুকে 'আটার বস্তা' বলে সম্বোধন করা ছেলেটিও বেশ সরব ছিল এই প্রতিবাদে।

আসলে আমরা জাতিগত ভাবেই বডিশেমিং ব্যাপারটিকে আপন করে নিয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বুঝতেই পারিনা এটা বডিশেমিং ছিলো৷ এই ধরুন, পাশের বাসার আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি অমুক মেয়েটিকে কালো বলে বডিশেমিং কেন করলেন? আন্টি ঝটপট উত্তর দিলো,  'এটা বডিশেমিং কোথায়? আমিতো মেয়েটি কালো, বিয়ে হবে কিভাবে, চিন্তিত হয়ে বললাম!' আন্টি মানতে নারাজ তিনি বডিশেমিং করেছেন।  

শুধু কি যিনি বডিশেমিং করছেন তারই বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যিনি বডিশেমিংয়ের শিকার প্রায়শই তিনিও বুঝতে পারছেন না।  বন্ধুর মুখ থেকে মোটকা, বাটকু, লম্বু, তালগাছ, কিংবা তালপাতার সেপাই ডাকনাম পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া বন্ধু হয়তো কখনো একে বডিশেমিং হিসেবে ভাবতেই পারেননি। 

তবে হিতে বিপরীত হয় তখন যখন মাত্রাতিরিক্ত বুলিং হয়ে যায়। আর সে বুলিংয়ের শিকার হয়ে কেউ নিজেকে একঘরে করে নেয় আবার কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। এরপর সমাজ জুড়ে শুরু হয় শোরগোল।  মাথাচাড়া দিয়ে জেগে ওঠে সবার বিবেক। কিন্তু তা হয় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। 'বডিশেমিং' নামক বিষয়টিকে আমাদের সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটন করতে সবার আগে দরকার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতনতা তৈরি। তাই এবার থেকে 'বডিশেমিং' নিয়ে প্রতিবাদমূলক পোস্ট দেয়ার আগে বন্ধুকে 'কোন গুদামের চাল খায় ' জিজ্ঞেস করা বন্ধ করুন।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ