Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

সাজিয়া আফরিন সুলতানা মিথিল। জন্ম ১৯৯৯ সালের ১০ ই মে ঢাকায়। সমাজের চিরাচরিত ভাবনার চাপে তলিয়ে গেলে হয়ত আজ আমরা এভাবে ফিরে তাকাতাম না। "বাংলাদেশে সচরাচর যেসকল নারীদের নিয়ে কথা হয় বা যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয় তাদের অধিকাংশই বয়স্ক মহিলা। সচরাচর তরুণী বা ইয়াং জেনারেশনের মেয়েদের নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। এই ব্যর্থতা কার আমি জানিনা।" কথায় কথায় বলছিলেন মিথিল। অবশ্য খুব যে ভুল বলেছেন সে দাবি আমরা করতে পারিনা। 

 

বাংলাদেশের অগ্রণী নারীদের অধিকাংশই সৌম্যকান্তির কিংবা গম্ভীর বয়স্ক মহিলা বলেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে। জীবনযুদ্ধে লড়তে লড়তে একসময় অর্জিত সিংহাসনের মধ্যে দেখেই আমাদের সকল আলোচনা। কিন্তু সেই সিংহাসনে পৌঁছানোর পূর্বে তাঁর যে অভিজ্ঞতা কিংবা তরুণ জীবনের প্রাণোচ্ছলতা তা নিয়ে স্মৃতিচারণ করা যায় মাত্র। একসময় সেই প্রাণোচ্ছলতাকে আড়ালে ফেলে দেয় গাম্ভীর্য এবং অভিজ্ঞতা। কিন্তু মিথিল সেই ধারাকে ভেঙে দেয়ার জন্যেই সম্ভবত এগিয়ে চলেছেন আপন ছন্দে। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

মিথিলের জীবনটা সংগ্রামের। আগাগোড়াই লড়াইয়ের। খুব ছোটবেলা থেকেই সমাজে নারীদের প্রথম সংগ্রাম শুরু হয় পরিবারের বিপক্ষে। মিথিল স্বভাবতই তার ব্যতিক্রম নয়। নারীর সুযোগ সুবিধা বেড়েছে। কিন্তু সেখানেও অসংখ্য বেড়াজাল আর নিষেধাজ্ঞার গণ্ডি। শিক্ষা নাও কিন্তু অতি বাড় বেড়োনা। মিথিলকেও শিকার হতে হয়েছে সেই সুযোগরুপী পরাকাষ্ঠার আক্রমণের। এলাকার ফুটবল ক্লাবে খেলার সুযোগ হয়নি শুধু মেয়ে বলেই।পরিবার থেকেই কখনো সেই সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। কিন্তু মিথিল নিজের উপর আস্থা রেখে সবসময় একাই সব সামলে নিয়েছেন। 

খুব ছোটবেলা থেকেই মিথিলের মধ্যে সৃষ্টিশীল কাজের ঝোঁক ছিল। হ্যাঁ, তার অনেকটাই হয়ত নিজের অজ্ঞাতেই। এই সময়ে কিছু স্নেহপ্রবণ শিক্ষক আর তার নানার কারণেই শিশু একাডেমিতে প্রবেশ। আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে পরিচয়। পরবর্তীতে MUN,  বিতর্ক, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, লেখালিখি, গান, থিয়েটার, বিভিন্ন সংগঠন কমবেশি করা হয়েছে সবই । এই অঙ্গনের থেকে পুরষ্কারও তার ঝুলিতে এসে সমৃদ্ধ করেছে অভিজ্ঞতা। সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেই সাংগঠনিক তৎপরতার হাতেখড়ি। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

 

আর এখন? মিথিলের বর্ণিল জীবনে কর্মযজ্ঞের আতিশয্যের প্রাসাদ আমাদের হতবাক না করে পারেনা। দায়িত্ব পালন করছেন গ্লোবাল পিসের কান্ট্রি কনভেনার হিসেবে। আছেন গ্লোবাল পিসের পিস এম্বাসেডর, এবং গ্লোবাল গুডউইলের এম্বাসেডর হিসেবে। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রজেক্ট বনলতা, হেলথ এন্ড হাইজিন অলিম্পিয়াড, তান-রাত ম্যানেজমেন্ট, এবং International Youth Change Maker-এ। কিছুদিন কাজ করেছেন রোটার‍্যাক্টর হিসেবে। কিছুদিন বিভিন্ন ফাউন্ডেশনে নারীদের বিনামূল্যে বেসিক ট্রেনিং দিয়েছেন। নিজের রয়েছে দুটো এন্টারপ্রেনারশিপ। এতকিছু নিজ হাতে সামলে চলেছেন মিথিল। 

এতকিছুর বাইরেও মিথিলের রয়েছে আরেকটি পরিচয়। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে ইন্ডিভিজুয়াল মাল্টিপল ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হোল্ডার মিথিল। বিশ্বরেকর্ডের দুয়ারে প্রবেশের গল্পটাও বেশ মজার। মিথিলের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা অবশ্য এথলেট হিসেবে। বাংলাদেশ আনসারের হয়ে জাতীয়তে খেলেছেন তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপ। সেখানে প্রবেশের পর নারী হিসেবে হতে হয়েছে ক্রীড়াক্ষেত্রে সকল বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি। ক্রীড়াক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, শিডিউলের অভাব, ফাউন্ডেশনের চাঁদার অভাব, এমনকি নিরাপত্তার অভাব নিয়েও মিথিল মত প্রকাশ করেন। ঠিক সেখানেই মিথিল বুঝতে পারেন এখানে থাকলে খুব বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হবেনা। এছাড়া শারীরিক অবনতির জন্যেও পিছিয়ে আসতে হয় তায়কোয়ান্দো থেকে। এমনকি পারিবারিক সহায়তাও ছিলোনা। কিন্তু মিথিল সেখানে অংশগ্রহণ করেই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন। তবে নিজের উপর আস্থা ছিল বলেই সময়টা পার করে আসেন। সকল বাধার কথা চিন্তা করেই তায়কোয়ান্দো থেকে সরে আসা। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার আগে ইন্টারনেটের সাথে মিথিলের সংযোগ ছিলোনা। সেই সময়েও মিথিল চারপাশ থেকে তথ্য সংগ্রহে মনোযোগী। পত্রিকাই তখন তার তথ্যের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা। আর নিজের ভাবনার জগতকে ঘিরেই মিথিলের পরিকল্পনা। বিশ্বদুয়ারে বাংলাদেশকে তুলে ধরার প্রবল আকাঙ্ক্ষা এবং নিজেকে মেলে ধরার প্রবল ইচ্ছেটুকুর জোগান সে নিজের কৌতূহল প্রবণতা থেকেই পাচ্ছিলেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে দাবী করা হয় তারা অনেক সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু আদৌ কি তা সত্য হতে পেরেছে? এখনো অনেক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেখানেও রয়ে গেছে সুযোগের অভাব। 

মিথিল জানায় ঠিক সেই সময় থেকেই সে ভাবতো, এমন কোন জায়গা আছে যেখানে নারীরা এখনো প্রবেশ করেনি। কথায় কথায় উঠে এল এই নিয়ে কথা। ইচ্ছার জগত কিংবা নারীর জগত এখনো বাংলাদেশে ক্ষুদ্র। ভারতের নারীরাও এদিকে বেশ এগিয়ে। অবশ্য তা নিয়ে মিথিলের মনে বিন্দুমাত্র হতাশা নেই। তার মতে বাংলাদেশ খুব বেশিদিন হয়নি স্বাধীন হয়েছে। তবে খুব দ্রুতই বাংলাদেশের নারীরাও আস্তে আস্তে নিজেদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে পারবে। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

ঠিক সেই সময়েই বিশ্বরেকর্ডের জগতে হাতছানি মিথিলের নজর কাড়ে। বিশ্বরেকর্ডের ব্যাপারে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণারও অবসান ঘটান মিথিল। বিশ্বরেকর্ড মূলত দু'ধরণের হয়। একটি অনারারি। রুনা লায়লা তিনদিনে ৩০ টি গান রেকর্ড করায় যে বিশ্বরেকর্ড পান তা সম্মানসূচক। কিন্তু মিথিল স্ব-উদ্যোগে বিশ্বরেকর্ড করেন। বিশ্বরেকর্ডের তত্ত্বাবধান যে শুধু গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডই করেনা সে কথাও জানান। সামনে আরো কিছু বিশ্বরেকর্ড করবেন বলে জানান মিথিল আমাদের। 

এ তো গেল বিশ্বরেকর্ডের কথা। এছাড়া সামাজিকভাবেও মিথিল বিভিন্ন সংগঠন বা এনজিওতে কাজ করে চলেছেন। নিজের মেধা, শ্রমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করেই নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধাবৃত্তির মাধ্যমে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখোমুখি হচ্ছেন চ্যালেঞ্জের এবং নিজ দক্ষতাবলে সেগুলো উৎরে যাচ্ছেন অনায়াসে।

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

শুধু বিশ্বরেকর্ডের অঙ্গনেই পা রেখে মিথিল থেমে নেই। সমাজে নারীর অগ্রগতি কিংবা নারীর অধিকারের পক্ষে মিথিল সোচ্চার৷ নিজের জীবনের ভিত্তিতেই সম্ভবত তার এই ক্রোধ। একে ঠিক ক্রোধ না বলে প্রতিবাদ বলাই শ্রেয়। এক নিকটাত্মীয়ের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পরেও কারো সাহায্য পায়নি মিথিল। কিন্তু তা নিয়েও সে সরব। যেন একা আলোকবর্তিকা হাতে সকলকে সাহস জোগাতেই সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। সকল অসত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষা মিথিলের। শুধু নারী নয়, শিশুদের উপর নির্যাতন নিয়েও মিথিল সোচ্চার। অপরাধীরা যেন তাদের যোগ্য শাস্তি পায় সেই সামাজিক আন্দোলনে সুর মিলিয়েছেন মিথিল। একইসাথে মানুষের অসহায়ত্ব দূর করার স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমেও নিজেকে আস্তে আস্তে জড়িয়ে ফেলছেন। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

সমাজে মানুষের জন্ম হয়ে জীবনের সংজ্ঞা নির্ধারণের সময় আসে বিভিন্ন পর্যায়ে। বাঁচলাম, জীবন-যাপনের রসদ জোগাড় করলাম এবং মরে গেলাম – তা মোটেও মিথিলের মূল উদ্দেশ্য নয়। নিজের জায়গা থেকে সে সমাজের জন্যে কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামনে ইচ্ছে আছে কিছু রেকর্ড সেট করার। কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও বা সংগঠনে। এই কর্মব্যস্ততাতেও কিছু নিকট বন্ধু, শিক্ষক, মা এবং নানার প্রেরণা অনেকটাই সাহস জুগিয়ে চলেছে মিথিলকে। 

 

মিথিল: নারীর নতুন পথের সন্ধানে

 

মিথিল এক আলোর মশাল হাতে এগিয়ে চলেছেন, নতুন কিছুর সন্ধানে। সেই মশালের আলো নির্দিষ্ট বার্তা হয়ত অনেককেই দেয়না। তবে এটুকু নিশ্চিত জানায়, নতুন কিছুর সন্ধানে নারীরাও এখন যেতে পারে। তাতে শুধু নিজের উপর আস্থা এবং নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মানটুকুই যথেষ্ট৷

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ