Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

‘বেদের মেয়ে জোছনা’র নাম শোনেনি এমন বাঙালি হয়তে পাওয়া যাবেনা। বাংলা গানে ফাঁকি দেয়ার সাথে তার নাম জড়িয়ে আছে। কেমন এই জোছনাদের জীবনযাত্রা? কেন তার নামের সাথে ফাঁকি দেয়ার কথা জড়িত রয়েছে? চলুন জেনে নেয়া যাক।

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

বেদেরা হল একটি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী। বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত হলেও ভ্রাম্যমাণতার কারণে তাদের যাযাবর বলা হয়ে থাকে। এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ নারী-পুরুষই ভাসমান জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাদের জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। তারা এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারেনা। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানোই যেন তাদের অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। বাংলা সাহিত্যে এই বেদে নারীদের কিন্তু বিশেষ স্থান দেয়া হয়েছে। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘মহুয়া’ এই বেদেকন্যারা আমাদের কাছে পরিচিত হলেও পরিচিত নয় বর্তমান প্রজন্মের বেদে সম্প্রদায় ও তাদের জীবনযাত্রা। 

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত জলবহুল-বিলবহুল-নদীবহুল অঞ্চলে দেখা যায় এই বেদেদের। বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, নোয়াখালীতে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের পাওয়া যায়। সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, তিনটুরী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেদের আবাসের কথাও জানা যায়। বেদেদের জীবনযাত্রা সাধারণদের থেকে বেশ ভিন্ন। বেদেদের মোট আটটি গোষ্ঠী রয়েছে। 

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

সাদামাটা জীবনযাপন তাদের। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে প্রতিটি দিন তারা কাটায়। একটু সুখের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কঠোর পরিশ্রম করে। নারী- পুরুষ উভয়ই সারাদিন কাজ করে। এরা রহস্যময় মানুষ। বেদেদের মূল পেশা হল সাপ খেলা দেখানো। তবে রহস্যে ঘেরা এই মানুষগুলো জাদু- টোনাও করতে পারে। সাপের কামড়ের চিকিৎসা করে তাবিজ বিক্রি করে। মাজা-কোমড়, হাত-পায়ের বাতের ব্যথা নিরাময়ের জন্য সিঙ্গা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, মৃত পশুর শরীরের অংশ ব্যবহার করে বা গাছপালা দ্বারা ওষুধ তৈরি করে বিক্রি করা, বানর খেলা দেখানো, জাদু দেখানো এগুলোই করেন বেদেরা।

 

বেদে মেয়েরা ভীষণ কর্মঠ ও পরিশ্রমী হয়। কাকডাকা ভোরে শিশু নিয়ে মনিহারি দ্রব্য বা সাপের ঝাঁপি নিয়ে বের হয় তারা। সারাদিন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দিনের শেষে ক্লান্ত দেহে ফেরে আস্তানায়। বেদেনিরা যখন গ্রামে গ্রামে পণ্য বিক্রির জন্য পরিভ্রমণ করতে যায়, তখন বেদেরা নৌকা পাহারা দেয়। বেদেরা কেবল জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে থাকে এবং নিজেরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এরা গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে। মহিলারাই বেশি গাওয়ালে যায়। তাদের সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষধের ঝুলি। গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। 

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

অনেক গোষ্ঠীতে বেদে পুরুষরা কাজ করে না। মেয়েরা যখন রোজগারে বাইরে যায় তখন সংসার ও সন্তান সামলায় তারা। বেদেনীরা তাদের এই অলস স্বামীদের ভীষণ ভালোবাসে। স্বামীকে দেবতার মতো মানে, সব সময় আগলে রাখে। 

 

বেদেনীদের পছন্দের সাপ হল ভয়ঙ্কর, উগ্র মেজাজের কালনাগিনী। তারা চালচলন আর স্বভাবে যেন এ কালনাগিনীরই অনুকরণ করে। রং-বেরংয়ের কাপড় পরিধান করে থাকে তারা। মহিলারা দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে, অন্য টুকরা গলায় ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রাখে এবং গায়ে পরে ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি। সাজতে ভীষণ ভালোবাসে তারা। কপালে টিপ আর উঁচু খোপায় ফুল গুঁজে দিয়ে, রঙিন শাড়ি পরে বেরিয়ে পড়ে দল বেঁধে। হাঁসুলি, বালা, বাজু, নোলক, পায়ের মল বা খাড়, বিছা এসব অলঙ্কার যুগ-যুগান্তরে আজও তাদের অঙ্গে শোভা পায়। মানুষকে আকৃষ্ট করতে তারা এই প্রসাধনের আশ্রয় নেয়।

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

সাধারণত শহর ও গ্রামে এদের যাতায়াত বেশি। এরা হিসাব-নিকাশ ভালো বোঝে এবং কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতায় থাকে। বৈরাগী শ্রেণির মেয়েরাও সারারাত জেগে বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরে পরদিন তা বাজারে বিক্রি করে এরা সারাক্ষণ নৌকায় থাকে। স্ত্রীরাও পুরুষদের মতো জীবিকার অন্বেষণে গ্রামে ঘুরে সাপের খেলা দেখায় সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করে।

 

এদের সমাজে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও যৌথপরিবার প্রথা নেই। বিধবা বিবাহে কোন বাধা নেই।  মহিলারা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি এমনকি পুত্র-কন্যারও বিভাজন হয়, যার বেশির ভাগ পায় স্ত্রী। আপাতদৃষ্টিতে বেদেরা পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায় এবং স্ত্রীকে স্বামী ও সন্তানের লালন-পালনের জন্য ওয়াদা করতে হয়। 

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

নারী ও পুরুষ প্রতিদিন সকালবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আর দিন শেষে ঘরে ফিরে আসেন। তবে ইদানীং এসব ব্যবসায় মন্দা ভাব দেখা দেয়ায় তারা সমাজের মূলধারার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।  তাদের কাজকর্ম এখন শুধু সাপ খেলা আর তাবিজ-কবজ বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা চুড়ি, ফিতা, বিভিন্ন শেকড়-বাকর বিক্রি ছাড়াও আদি ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতির অনেক উপকরণও তারা বিক্রি করে থাকে।

 

তবে বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিরুদ্ধে সাপ দেখিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে টাকা আদায় করার অভিযোগ বহু পুরনো। এ নিয়ে পথচারীরা উটকো ঝামেলায় পরে। মাঝে মধ্যেই তারা শহর-গ্রাম-হাট বাজার দাপিয়ে বেড়ায়। জীবন ধারণের জন্য তাদের অর্থ আদায়ের কৌশল ভিন্ন এবং বেশ আতঙ্কজনক।

 

জোছনা’দের ফাঁকি দেবার গোপন রহস্য

 

বেদেরা আমাদের দেশের অন্যতম সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। বিশ্বায়নের যুগের সঙ্গে এই মানুষগুলো তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। সমাজের মূলধারার জনগণের সঙ্গে তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি আলাদা হওয়ার কারণে তারা অনেকটাই পশ্চাৎপদ। নাগরিক অধিকার পেলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার নেই কোন সুব্যবস্থা। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড়ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। আগের মতো মানুষ সাপ খেলা দেখে আর এখন আনন্দ পায় না। বেদেরা আমাদের সমাজের এতই প্রান্তিক একটি অবস্থানে রয়েছে যে আমাদের জাতীয় পরিসংখ্যানে পর্যন্ত তাদের কোন গুরুত্ব নেই। মাত্র ২০০৮ সালে বেদেদের একটি বিশাল অংশকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। বেদেরা শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। সরকারিভাবে তাদের জন্য বৃত্তি, ভাতা ও প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন ব্যবস্থা থাকলেও সামাজিকভাবেও এরা চরম অবহেলিত। এদের শিক্ষা ও সার্বিক উন্নতির দিকে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত।

 

বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও সমস্যাসঙ্কুল হল বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। কালের বিবর্তনে এই যাযাবরেরা হারিয়ে যাচ্ছে। নগরায়নের ফলে আগের মতো জায়গা পরিবর্তন ও ঘুরে বেড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে। এভাবেই হয়ত একসময় একেবারে হারিয়ে যাবে এই যাযাবরেরা।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ