Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

আমাদের সমাজ এখনো পুরোপুরি নারীবান্ধব নয়। 'নারী-পুরুষ সমান অধিকার ' ট্যাগলাইন হাতে নিয়ে এখনো নারীদের হাঁটতে হয় তার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাতাকলে বহু নারীই নিজেকে গুঁটিয়ে নেন এক কোণে। কিন্তু কেউ কেউ আবার শত প্রতিবন্ধকতা ঠেলে সোচ্চার হন অধিকার আদায়ে, ছিনিয়ে আনেন সফলতা নামের সোনার হরিণ। তেমনি এক লড়াকু নারী অপরাজিতা সংগীতা। বর্তমানে বাংলাদেশের একজন সফল নারী পরিচালক। 

 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

 

বাংলাদেশের কোন এক বিজয় দিবসে (১৬ই ডিসেম্বর) নড়াইলে তার জন্ম। তার শৈশব কাটে এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। ছোটবেলায় লেখাপড়ার পাশাপাশি একইসাথে হাতেখড়ি হয়েছিলো  নাচ, গানেও। বাবার কাছেই মূলত তার হাতেখড়ি। বাবা গান লিখে সুর করে দিতেন আর তিনি গাইতেন। তার ভাষায়, "আজকের এই 'আমি' যতটুকু 'আমি' হয়েছি, সেটার ভিত ছোটবেলাতেই আমার বাবা তৈরি করে দিয়েছিলেন। "

 

আজকের অপরাজিতা যিনি ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুলছেন কত শত চিত্র, ছোটবেলায় তাকে নিয়ে মা-বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন মেয়ে একজন ডাক্তার, নামকরা ডাক্তার হবে। পড়াশোনায়ও ছিলেন বেশ ভালো, তাই বাবা-মায়ের স্বপ্ন দেখাতেও দোষ ছিল না।  কিন্তু অপরাজিতা চাইতেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ বা অনুসন্ধানী সাংবাদিক হতে। মূলত ছোটবেলায় পড়া প্রচুর গোয়েন্দা গল্পই তাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছিলো। তবে, সে যাই  হোক একদিন সিনেমা বানাবেন, পরিচালক হবেন এই চিন্তা মাথার কোনও অংশেই ছিল না।

 

শৈশবে অনেক ধরণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করলেও তার কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিলো জাপানে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদের একটা স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন তিনি। সেখান থেকে দেশে ফেরার পর কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে পেশায় তিনি একজন ফটোগ্রাফার। এছাড়া ছোট্ট একটা প্রোডাকশন হাউজও আছে। 

 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

 

তার পরিচালক হয়ে ওঠার ইচ্ছে  জাপানে থাকাকালীন সময়ে।  চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের ‘মাই জাপানিজ ওয়াইফ’ চলচ্চিত্রে হাতে কলমে কাজ করার মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। তখন প্রথম সিনেমার প্রতি তিনি তার আগ্রহটা উপলব্ধি করতে পারেন।  এরপর দেশে ফিরেও আবার তার ‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন অপরাজিতা। 

 

জিতা সংগীতা  অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে রাজপথে আন্দোলন করেছেন, লেখালেখিও করেছেন। তাই এসব ধরণের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তার মনে হয়েছে চলচ্চিত্র খুব শক্তিশালী একটা মাধ্যম। কোনও বিষয়ে লিখে বা বলে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেয়ে চলচ্চিত্র মাধ্যমে বেশি সহজে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা এবং চলচ্চিত্র নিয়ে তার আগ্রহ; দুটো মিলিয়েই এ পথে তার যাত্রা শুরু। 

 

পরিচালক হিসাবে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পুরুষাতঙ্ক’। প্রতিদিন চারপাশে অহরহ নারী নির্যাতনের ভয়াবহ সব ঘটনা দেখতে দেখতে একজন নারী নির্মাতা হিসেবে তিনি তার নারী সত্ত্বার কিছু অনুভূতিকে এই চলচ্চিত্রে তুলে ধরতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম, প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হবার ভয়, পুরুষের আক্রমণের আতঙ্ক, এসব গল্পই স্বল্প পরিসরে ফুটে উঠেছিলো 'পুরুষাতঙ্ক' ছবিটিতে।

 

তার নির্মিত প্রথম এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বেশ আলোচনা – সমালোচনা হয়েছিলো। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে 'পুরুষাতঙ্ক' নাম দেখেই অনেকে তার গায়ে 'পুরুষবিদ্বেষী', বলে ট্যাগ  দিয়েছেন। বলেছেন, পুরুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন তিনি। ছবিটি দেখার পর অবশ্য বেশিরভাগেরই এই মনোভাব বদলেছে। এছাড়াও সেবার দেশের বাইরে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও রয়েছে ‘পুরুষাতঙ্ক'-র ঝুলিতে। তাই বলা যায়, নিজের প্রথম কাজেই তিনি সফলতার মুখ দেখেছিলেন।  

 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

 

প্রথমেই বলেছিলাম আমাদের সমাজ যে এখনও নারীবান্ধব নয়। তাইতো পাক্ষিক অনন্যার তরফ থেকে অপরাজিতা সংগীতার কাছে প্রশ্ন, 'একজন নারী হয়ে পরিচালনার মতো পেশায় আসা এবং কাজ করা, এগিয়ে যাওয়া। এ বিষয়টিতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল কি?'

 

প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, "আমাদের সমাজে নারীদের জন্য প্রতিটি পদেপদেই  প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। মিডিয়ায় কাজ করার ক্ষেত্রে সেটা অনেক বেশি। কারণ মিডিয়ায় মেয়েদের কাজ করাটাকে আমাদের দেশে ভালো চোখে দেখা হয় না। আমার প্রথম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিলো আমার পরিবারে। আমি যখন প্রথম বাড়িতে জানালাম যে আমি মিডিয়ার কাজ করবো, সিনেমা বানাবো; সবার মাথায় যেনও আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিলো। সবার সে কি রাগ, অভিমান! আত্মীয়-স্বজনের অনেকের সাথেই সম্পর্কের ছেদ হয়েছে শুধু মাত্র মিডিয়ায় কাজ করার কারণে। "

 

সাথে সাথে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার কথাও জানান তিনি। বলেন, " একসময় আমার পরিবারের সবাইকে যখন বোঝাতে পারলাম যে  এই কাজটা করেই আমি আনন্দ পাই, তখন সবাই মেনে নিয়েছে। এখন আর কোন বাঁধা নেই বরং আমার কাজকে সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করে।"

 

সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এ যাবৎ দর্শকদের বেশ অনেকগুলো কাজ উপহার দিয়েছেন তিনি।  যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পুরুষাতঙ্ক’, 'রিভোল্ট', 'ছাড়পত্র'। যা দিয়ে অর্জন করেছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারও। ২০২০ সালেই 'রিভোল্ট' ৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত 'তৃতীয় বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১'-এ 'বিশেষ জুরি পুরস্কার'টি অর্জন করেছে 'রিভোল্ট'।

 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

 

এর আগে 'পুরুষাতঙ্ক' এবং 'ছাড়পত্র'ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে। ছবিগুলো  ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়ে দর্শকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। এই বছরের শুরুতে আমেরিকার একটি ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়েছিলো 'পুরুষাতঙ্ক' এবং 'রিভোল্ট'। যেখানে তাদের টিমের ৬ জনের অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু করোনার কারণে ফেস্টিভ্যাল বন্ধ হওয়ায় ফেস্টিভ্যালের বাছাইকৃত চলচ্চিত্র হিসাবে আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেলে 'পুরুষাতঙ্ক' এবং 'রিভোল্ট' প্রচারিত হয়েছে। 

 

এছাড়া তিনি প্রাণ ও প্রকৃতির উপর করোনার প্রভাব, সরকারী পাটকল বন্ধ হওয়া এবং ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। অপরাজিতা সংগীতা পরিচালিত  চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে নারীর প্রাধান্য দেখা যায়, আবার গল্পগুলোও নারীদের ইস্যু নিয়ে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এর বিশেষ কোন কারণ আছে কি? 

 

তিনি বলেন, "আমরা নারীরা প্রায় সবাই প্রতিনিয়ত পুরুষদের দ্বারা কম-বেশি হেনস্থার শিকার হই।  আমাকেও অন্য দশজন নারীর মত অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বা এখনও যেতে হয়। সেসব ঘটনা থেকে প্রভাবিত হয়ে আমি আমার চলচ্চিত্রে নারীসত্ত্বার খুব চেনাজানা অনুভূতিগুলোকে সামনে আনার চেষ্টা করেছি। এছাড়া পুরুষ নির্মাতারা নারী চরিত্রের উপস্থাপন করেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে৷ যেটা অনেক সময় সঠিক না-ও হতে পারে। তো, একজন নারী হিসেবে আমি যখন নারীদের চরিত্র, তাদের প্রতি বৈষম্য কিংবা সহিংসতা তুলে ধরি সেটার উপস্থাপনটা হয় নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। ফলে তা বাস্তবতার কাছাকাছি হয় বলে আমি মনে করি।"

 

অদূর ভবিষ্যতে ‘যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচয়-ভিত্তিক বৈচিত্র্য’ বিষয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করবেন বলে জানান তিনি । সব ঠিক থাকলে এ বছরের শেষে তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার নির্মাণ কাজ শুরু হবে। যেটার গল্পও নারী কেন্দ্রিক। এছাড়াও বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতার বায়োপিক নির্মাণের কথাও চলছে। 

 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

 

অপরাজিতার মতে পরিচালকের আসনে আমাদের দেশে নারীদের খুব একটা দেখা না যাওয়ার কারণ, "আমাদের সমাজ এখনও একজন নারীর নির্দেশ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সমাজ পুরুষের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়। শুরুর দিকে আমি কয়েকজন পুরুষ ডিরেক্টরের সিনেমায় কাজ করেছি। তখন দেখেছি সিনেমার সেটের মধ্যে একজন ডিরেক্টরকে সবাই ভীষণ মান্য করে। কিন্তু আমি ডিরেক্টর হয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম ক্রুদের মধ্যে কেমন একটা গা ছাড়া ভাব। শুধু নারী বলেই যোগ্যতা প্রমাণের জন্য বাড়তি এফোর্ট দিতে হয়। আমার মনে হয় এসব কারণেই নারীরা এই পেশায় কম আসে।"

 

জন্ম থেকেই পরিবারের ভয়, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নারীদের সামনে একটা বিধিনিষেধের সীমা বা দেয়াল তৈরি করে। কাজ করার অনুকূল এবং সঠিক পরিবেশ পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলে অনেক নারীই এই পেশায় কাজ করতে আগ্রহী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। 

 

সম্প্রতি বগুড়ার একটি রেস্টুরেন্টে হিন্দু তরুণীকে চিংড়ি মাছের সাথে গরুর মাংস মিশিয়ে পরিবেশন করার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে তিনি 'উপলব্ধি ' নামের একটি ওভিসি নির্মাণ করেছেন। আসন্ন কোরবানির ঈদে বগুড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা থেকে ঈদের পূর্বেই ওভিসি'টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হবে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে এটি জোরালো মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে৷ 
 

অপরাজেয় এক অপরাজিতার গল্প

চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি এই নারী  বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজের সাথেও যুক্ত। পথশিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবার ক্ষুধার্তদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার প্রজেক্ট ‘ফুড ব্যাংকিং’, জরুরি রক্তদান কার্যক্রমসহ দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত কিছু কাজের সাথে তিনি দীর্ঘদিন যাবত যুক্ত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তিনি করেছেন তা হল মরণোত্তর চক্ষুদান এবং মরণোত্তর দেহদান।

 

শুধু মানুষকে বিনোদিত করা কিংবা বাণিজ্যিক কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা তার উদ্দেশ্য নয়। তিনি শিল্পমানসম্মত এবং বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান। তার কাজের মধ্যেই ঘুরে ফিরে নারী ইস্যু, সমাজের নানান অসঙ্গতি, বৈষম্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তুলে ধরতে চান। 

 

তার প্রত্যাশা নিজের অবস্থান একদিন এমন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন যেন একদিন পুরো সমাজ বলতে পারে , "দেখো, এই মেয়েটি পেরেছে"।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ