Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অভূতপূর্ব জীবনের পথ প্রদর্শক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়

ব্যতিক্রমী এক পথ প্রদর্শকের অভূতপূর্ব জীবন মাধুর্য ছড়াতে জানে। সেই সময়ের কলকাতায় নিজের ফিটন গাড়িতে চড়ে কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের দেখা যাওয়াটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু প্রথম বাঙালী নারী ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকেও তার ফিটন গাড়িতে চড়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে দেখা যেতো। ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে নারীদের সবসময়ই স্বাবলম্বী হতে ঘর এবং কর্মক্ষেত্র দুটোই সামলাতে হয়েছে৷ 

 

সময়টাই ভেবে দেখা যাক। কলকাতা যাকে তখনো পুরোপুরি সিটি অব জয় বলা যায়না। সোডিয়াম ও নিয়ন আলোয় আলোকিত কলকাতার কর্মজগতে তখনো প্রবেশ করতে ইতস্তত করছে নারীরা। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের প্রবেশ তখন স্বীকৃত কিন্তু সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। সেসময় চুটিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। যত রাতই হোক, রোগী দেখতে ফিটনে চেপেছেন। প্রাইভেট চেম্বার খুলে কাগজে সে বিজ্ঞাপন দেয়ার মতো সৎ সাহস ছিল তাঁর। অস্ত্রোপচার করাতেও তাঁর কোন ভয় ছিলোনা। এমনকি মৃত্যুর আগেও তিনি একটি অস্ত্রোপচার সেরে এসেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ভিজিটের পঞ্চাশ টাকা পাওয়া গিয়েছিলো। এই বর্ণিল জীবন বর্তমান সময়ের হিসেবে নিছক সাধারণ মনে হলেও এ বিশ শতকের কলকাতা। 

 

তবে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাদম্বিনীকে মুখোমুখি হতে হয়েছে অসংখ্য বাধাবিঘ্নের। কলকাতার পুরুষ-শাসিত কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাক্ষেত্র বিভিন্ন সময়ে তাঁকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র সৎ সাহস এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। ডাক্তারি ডিগ্রির বদলে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা জিএমসিবি উপাধি। তবু কাদম্বিনীকে দমানো সম্ভব হয়নি। কলকাতায় নিজের যোগ্যতার মূল্যায়ন তিনি পাননি। কাদম্বিনী ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েটদের একজন। সেখান থেকেই সমাজ কিন্তু বিষয়টিকে সম্ভাবনাময় বলে মেনে নিয়েছে তা বলা চলেনা। বর্তমানের সাথে তখনের উৎসাহকে মেলালে ভুল হবে অবশ্যই। 

 

কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমবিবিএস করবেন। ১৮৮১ সালে আবেদন করে মেডিকেল সোসাইটি থেকে কোন অনুমোদন পাননি। তখন তিনি বি.এ পড়া শুরু করলেন। আবার দুই বছর পর আবেদন করেন। এরমাঝে তাঁর বিয়ে হয় দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে৷ এই বিয়ে নিয়েও ব্রাহ্ম সমাজে তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। একে তো দ্বারকানাথ বিপত্নীক তার উপর দুই সন্তানের জনক। কাদম্বিনীর সাথে তাঁর বয়সের পার্থক্যও নেহাত কম নয়। তবে সেসময় সেটা খুব বড় বিষয় না। যাহোক, কাদম্বিনী জীবনসঙ্গী নির্বাচনে ছিলেন সতর্ক। দ্বারকানাথ নিজে ছিলেন উদারবাদি এবং দূরদর্শী। তাই তাদের সাংসারিক জীবন মানানসই হয়ে উঠেছিলো। 

 

১৮৮৩ সালে তিনি মেডিকেলে ভর্তি হন। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি। তারমধ্যে রাজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত নামক একজন তো কাদম্বিনীকে বরদাস্তই করতে পারতেন না। তিনি মেডিসিন পেপারে কাদম্বিনীকে এক নাম্বারের জন্যে ফেল করিয়ে দেন। সেসময় মেডিকেলে মেয়েদের নানারকম কটূক্তি, অশ্লীলতা এবং বাজে আচরণের শিকার হতে হতো৷ কাদম্বিনীর ক্ষেত্রে তা হয়েছিলো কিনা আমরা জানতে পারিনি। তবে তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন।

 

কাঙ্ক্ষিত মেডিকেল ডিগ্রি না পাওয়ার পরেও কাদম্বিনী ঠিক তা নিয়ে কাউকে দোষারোপ করেন নি। বরং তিনি বিলেতে ডিগ্রি গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সন্তানদের রেখে বাইরে ডিগ্রি নিতে যাওয়ার পদক্ষেপ প্রশংসার দাবী রাখে। ডিগ্রি নিয়ে ফেরার পর তাঁর ছোট সন্তানও প্রথমে চিনতে পারেনি। তাও সংসারের চাপ কাদম্বিনীর ক্যারিয়ারকে বিঘ্নিত করেনি। খোদ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একটি চিঠির মাধ্যমে কাদম্বিনীকে শুভকামনা জানিয়েছেন। তাঁর চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, "ভারতের মতো গোঁড়া দেশের একটি মেয়ে বিয়ের পর ডাক্তারি পড়ছে এবং একটি বা দু’টি সন্তানের জন্মের সময়েও মাত্র তেরো দিন কলেজ কামাই করেছে এবং সম্ভবত একটি লেকচারও মিস করেনি!"

 

অধ্যাপক চন্দ্র তাকে একাধিকবার ফেল করিয়েছিলেন। অবশ্য কলেজের অধ্যক্ষ অনুধাবন করেছিলেন যে কাদম্বিনীর সাথে অন্যায় হচ্ছে। চিকিৎসক জে এম কোটসই তাকে 'গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা জিএমসিবি উপাধি দেন। এভাবেই কাদম্বিনী মেডিকেল প্র্যাকটিসের ছাড়পত্র পান। কোটস ইডেনে তাকে কাজের সুযোগ করে দেন। তবে এমবিবিএস না থাকায় তিনি নার্সের সমান মর্যাদা পেতেন। সেজন্যেই বিলেতে ডিগ্রি নেয়ার জন্যে তার এগিয়ে যাওয়া৷ ডিগ্রি না পাওয়ায় আত্মমর্যাদায় আঘাত পেয়েছিলেন। বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্যে তিনি নিজেই টাকা জোগাড় করেছিলেন। 

 

নারী উন্নয়নেও তাঁর অবদান ছিল। শিকাগো মহাসম্মেলনের প্রদর্শনীতে ভারতীয় নারীদের শিল্পকর্ম পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছিলেন। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তিনি তিনটি ডিপ্লোমা অর্জন করেছিলেন – এলআরসিপি, এলআরসিএস এবং এলএফপিসি। তাঁর এই অর্জনের জন্যে দেশে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ডাফরিন হাসপাতালে নিজ যোগ্যতায় চাকরী পেলেও তিনি নিজে ঘরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু করেন। এভাবেই তাঁর পসার জমে ওঠে। 

 

কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের ইতিহাসটুকু অনেকটাই যান্ত্রিক বলেই ঠেকছে। অন্তত আমার লেখাতেও। কিন্তু কাদম্বিনীর ছিল স্পর্শকাতর এবং শিল্পোন্নত মন। কিন্তু এখনো এই সময়ে এসে সামলম্বী হয়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার এই প্রেরণা কাদম্বিনী আমাদের দিয়ে যান। মৃত্যুর আগেও তিনি একটি অস্ত্রোপচার সেড়েছিলেন। বাড়ি ফিরে নিজের কাজের তৃপ্তি নিয়ে বসেছিলেন। আর তারপর মহাকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা সেড়েছেন। রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় ইতিহাস।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ