শরণার্থী শিবির থেকে ফুটবল মাঠের রানী হওয়ার গল্প
আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর পূর্বে, ১৯৮৮ সালের ২রা জানুয়ারি। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের হেরাত শহরে ছোট্ট একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন একটি কন্যাশিশু। যার নাম রাখা হয় নাদিয়া নাদিম। নাম শুনে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আন্দাজ করে নিয়েছেন আজকের গল্প কাকে নিয়ে এগোবে?
ফুটবল জগতের পরিচিত এক মুখ নাদিয়া নাদিম। পুরো বিশ্বজুড়েই তার রয়েছে বেশ নামডাক। তাই নিয়মিত ফুটবল জগতকে অনুসরণ করেন আর নাদিয়া নাদিমকে চিনেননা এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য। জন্ম আফগানিস্তানে হলেও ২০০৯ সাল থেকে নাদিয়া ডেনমার্কের জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলছেন।
শুধু ডেনমার্কের জাতীয় দলেই নয় পাশাপাশি তিনি খেলেন জনপ্রিয় ক্লাব পিএসজির হয়ে। অবশ্য সম্প্রতি পিএসজি ছেড়ে আমেরিকান ফুটবল ক্লাব রেসিং লুইসভিলে এফসিতে যোগ দিয়েছেন নাদিয়া। ২০১৮ সালে ম্যানসিটিতেও খেলেছেন তিনি। ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে এ পর্যন্ত তিনি ৯৮টি ম্যাচ খেলেছেন এবং গোল করেছেন ৩৮টি। এছাড়াও ক্লাব ফুটবলে তিনি এ যাবৎ গোল করেছেন ২০০ এর বেশি।
এসবই তো গেলো তার ক্যারিয়ার নিয়ে ক্ষুদ্র এক আলোচনা। কিন্তু তার বর্তমান এ সফলতার পেছনে রয়েছে এক কঠিন জীবনসংগ্রামের গল্প। যা তাকে বিশ্ববাসীর কাছে আরো আলোচিত করে তুলেছে। এমনকি তার জায়গা মিলেছে বিশ্বের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বসে। যেখানে তার নাম উঠে এসেছে মোস্ট পাওয়ারফুল ওমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টসের তালিকায়।
তার সংগ্রামী জীবনের সে গল্পের শুরুতে কোথাও ছিলোনা সফলতার ছিটেফোঁটাও। বরং ছিল কষ্ট, দুর্দশা এবং হতাশায় ভরপুর এক জীবন। নাদিয়ার বাবা ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল। জন্মের পর থেকে পরবর্তী ১২ বছর সব ঠিকই চলে তার জীবনে। কিন্তু ২০০০ সালে তাদের উপর নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তালেবানদের হাতে নিহত হন নাদিয়ার বাবা।
তিনি ও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও আফগানিস্তান ছেড়ে শরণার্থী হওয়ার কথা ভাবতে হয় তাদের। যার ফলস্বরূপ পরবর্তীতে ট্রাকের পিছনে করে নাদিয়ার পরিবার পাড়ি জমায় ডেনমার্কে। এরপর সেখানেই মূলত শুরু হয় তার ফুটবল জগতের যাত্রা।
শুরুতে তিনি বি৫২ আলবোর্গের হয়ে খেলেন। এরপর টিম ভিবর্গের হয়ে খেলতে দেখা গেছে তাকে । এরপর সেখান থেকে স্কাই ব্লু এফসিতে। এরপর পিএসজি এবং সর্বশেষ রেসিং লুইসভিলে এফসি। নিঃসন্দেহে তিনি একজন ফুটবলপ্রেমী মানুষ। তাইতো ৩৩ বছর বয়সেও চলছেন দুর্বার গতিতে। বরাবরই তিনি প্রমাণ করছেন এখনই ফুটবল মাঠের এ যাত্রায় থামতে নারাজ তিনি।
তবে তাই বলে তিনি শুধু সবুজ মাঠের বাউন্ডারির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি। নিজেকে শুধু একজন ফুটবলার নয় তৈরি করেছেন একজন মেডিকেল সার্জন হিসেবেও। এছাড়াও তার রয়েছে বিশ্বের ১১ টি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা। কঠিন এক সংগ্রামী জীবন পাড়ি দিয়ে এতোসব সফলতা ছিনিয়ে আনার জন্যই তিনি আজ ফোর্বসের মোস্ট পাওয়ারফুল ওমেন ইন ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টসের তালিকায়।
জীবনে কঠিন পরিস্থিতিতেও টলে পড়েননি তিনি। বরং সাহস সঞ্চার করে এগিয়েছেন অজানাকে জানার জন্য, ভয়কে জয় করার জন্য। শরণার্থী শিবিরে ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে নীল আকাশে ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি, করেছেন বাস্তবায়নও। দেখিয়েছেন কিভাবে শত বাঁধা পেরিয়ে ছিনিয়ে নিতে হয় সফলতা নামের সোনার হরিণকে। আর এভাবেই নাদিয়া নাদিম পুরো বিশ্বের নারীদের কাছে হয়ে উঠেছেন একজন রোল মডেল৷