Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পিরিয়ডের সময় চাই মানসিক যত্ন

দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে নেহা। তার বসবাস একটি যৌথ পরিবারে। যেখানে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক লোক পুরুষ এবং রয়েছে বেশ অনেকগুলো দুরন্ত স্বভাবের বাচ্চাও। নেহাও বেশ চটপটে মেয়ে।  ঘরের সকলের খেয়াল রাখা, হাসিমুখে কথা বলা, বাচ্চাদের সাথে সারাদিন হইচই করে খেলাধুলা করা তার প্রতিদিনকার রুটিন বলা চলে।  কিন্তু মাসের কয়েকটা দিন তার মেজাজের বেশ নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। 

সারাদিন দুরন্তপনায় মেতে থাকা মেয়েটা কখনো চুপচাপ, কখনো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে যায়। একঘরে বন্দী হয়ে থাকে পুরো বাড়ি দাপিয়ে বেড়ানো মেয়েটি। কিন্তু ৪-৫ দিনের জন্য তার এই  মানসিক পরিবর্তন খুব একটা আমলে নেন না বাড়ির কোন সদস্যই। তাইতো ঘরের এককোণে বসে আরো হতাশায় ভুগতে থাকে সে। এ চিত্র শুধু নেহার ঘরের একার নয়। আমাদের সমাজের বহু ঘরের চিত্র এটি। পিরিয়ডের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিটি মেয়েকেই যেতে হয় এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে। 

আর এ ঘটনা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পিরিয়ডের সময় মেজাজের নাটকীয় কিছু পরিবর্তন ঘটে যেমন- হঠাৎ করে খুব মেজাজ খারাপ লাগতে থাকা, বিষণ্ণতা, কান্না পাওয়া ইত্যাদি। এর থেকেই সে সময়টিতে তৈরি হতে পারে বড় ধরনের হতাশা। তাই এই সময়টাতে দরকার মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষ যত্ন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে পিরিয়ডের সময় মানসিক যত্নকে আমরা কেউই ঠিকঠাক আমলে নেই না। অন্যদিকে নারীরা এসময়টাতে এতটাই সংকোচে ভোগেন যার কারণে হতাশা হয়ে যায় দ্বিগুণ। 

আর এর পেছনে সবথেকে বড় কারণ হল আমাদের সমাজের রক্ষণশীলতা। চলুন এবার একটু অভিজ্ঞতার গল্প বলি – সপ্তম শ্রেণীতে উঠে 'শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য' নামক একটি বই পেয়েছিলাম । নতুন বই পেয়ে উৎসাহ নিয়ে প্রতিটি বই নাড়াচাড়া করছিলাম।  তার ধারাবাহিকতায় এই বইটিও বাদ যায়নি। বইটিতে শরীর চর্চা, খেলাধুলাসহ অনেক মজার মজার পড়াশোনা ছিল, সাথে ছিল ঋতুস্রাব, বয়ঃসন্ধিকাল, প্রজনন স্বাস্থ্য এমন কিছু টপিকও।  সবগুলো টপিক শিক্ষক খুব উৎফুল্ল মনেই পড়িয়েছিলেন, কিন্তু এসব টপিকের সময় তিনি মাথা নিচু করে বলেছিলেন এই অধ্যায়টি বাড়িতে পরে নিবে। 

সেদিন বেশ অবাক হয়েছিলাম। স্যারের মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো হয়তোবা বইয়ের লেখক কোন অন্যায় করেছেন অথবা স্যার। নাহয় এমন গোমরা মুখ কেন? সেদিন মনে হাজারো প্রশ্ন জমে থাকলেও উত্তর পাইনি। বেশ কিছুদিন পর উত্তর পেয়েছিলাম নিজে থেকেই, আর ঘরের এককোণে ডেকে নিয়ে গিয়ে সাহায্য করেছিলো মা।  আগে -পিছে সবটা মিলিয়ে বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।  স্যারের সেই অপরাধী মুখ এবং মায়ের এমন কাচুমাচু ভঙ্গি দুটোই বারবার মাথার মধ্যে ঘুরছিলো আর মনে হচ্ছিল, 'পিরিয়ড বা মাসিক নামক এই ব্যাপারটি কি খুব বড়সড় রোগ? সবাই কেন মাথা নিচু করে নেয় কথাটি শুনলে?'

উত্তর পাইনি বরং আমিও অপরাধবোধ নিয়ে ঐদিনগুলোতে মাথা নিচু করেই হাঁটতাম। হুট করেই যে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম, ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে থাকতাম। মন ভালো করে দেয়া পরিস্থিতিতেও বিষণ্ণতায় ভুগতাম। আবার ৪-৫ দিনের মধ্যে ঠিকও হয়ে যেতাম। কিন্তু একসময় আতঙ্ক তৈরি হল, সামনের মাসে আবারও এমন মানসিক চাপ সহ্য করতে হবে। এ আতঙ্ক আমাদের সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি মেয়ের মধ্যে বিদ্যমান। 

আমাদের এই রক্ষণশীল সমাজে পিরিয়ডকে একটি বড়সড় রোগই ভাবা হয়। মেয়েদেরকে সাধারণত এক ঘরে করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।  একে তো এ সময়টাতে স্বাভাবিকভাবে মানসিক অবস্থার এমন ওঠাপড়া তার উপর এসব মানসিক চাপ। আমরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে অনেক সামাজিক ট্যাবুই ভেঙে দিচ্ছি ঠিকই। শারীরিক বেশ কিছু বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে কিন্তু  মানসিক যত্নও যে হতে পারে, সে ব্যাপারে আমরা কখনো চিন্তাই করিনি।  চলুন তবে এখন চিন্তা করা যাক,  পিরিয়ডের দিনগুলোতে মানসিক যত্ন নিতে ঠিক কি কি ভূমিকা পালন করা যেতে পারে-

 

 

১. খাবারদাবারে পরিবর্তন আনতে হবে। সবরকম জাংকফুড, ক্যাফিন জাতীয় পানীয় বা অ্যালকোহলও একেবারেই দূরে রাখতে হবে। প্রচুর ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যা মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে।

 

২. কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। তবে কঠিন কোন ব্যায়াম একদমই নয়। ব্যায়ামের ফলে মন শান্ত থাকবে, মন খারাপ দূর হবে। 

 

৩. এ সময়টাতে ঘরের এক কোনে হতাশ হয়ে বসে না থেকে আপনার শখের কোন কাজ করতে পারেন যা আপনাকে আনন্দ দেয়। পছন্দের কোন বই পরতে পারেন, মুভি দেখতে পারেন। 

 

৪. আর সবথেকে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। মেয়েকে একঘরে না করে দিয়ে সকলে মিলে গল্প কিংবা আড্ডা দিতে পারে। তাকে বোঝাতে পারে যা হচ্ছে তা খুবই স্বাভাবিক। 

 

৫. শুধু পরিবারই নয়, এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষক -শিক্ষিকা,বন্ধু-বান্ধব, কলিগদেরকেও। কারণ পরিবার ছাড়াও একজন নারী দিনের বেশিভাগ সময় এদের সাথে কাটাতে পারে, তাই এসময়টাতে সকলে একসাথে গল্প করলে, খোলাখুলিভাবে কথা বললে অনেকটাই মানসিক চাপ কমে যাবে। 

 

মানসিক সুস্থতা শারীরিক সুস্থতার মতোই একটি বড় বিষয়। আবার তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণও বলা যায়। তাই আমাদের মাসিকের সময় যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে তা মোটেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে চলবেনা। নিজেদের সচেতন হতে হবে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ