Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উনিশ শতকের ‘পণ্ডিতা’ ও ‘সরস্বতী’ রমাবাঈ

সুপ্রাচীনকাল থেকে আধুনিককালে ভারতীয় নারীর অবস্থা বহু বার পরিবর্তিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ভালো কাজের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজেকে খ্যাতিমান করে তোলে। কিন্তু সমাজসংস্কারকদের প্রায়ই শুরুতে কিছুটা ‘দুষ্ট গরু’ হিসেবেই ভাবা হয়। বিশেষত, নারী সমাজসংস্কারকের আবির্ভাবকে সমাজ কখনোই ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। ভারতীয় নারীর সমাজসংস্কারের প্রচেষ্টা আধুনিককালেই সব চেয়ে বেশি মনোযোগ কেড়েছে।

উনিশ শতকের শুরুর দিকেই যেন সমাজে নারীদের বাঁধ ভাঙার সময়। নারী-শিক্ষাকে কেন্দ্র করে বহু নারী উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বাংলায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহসী পদক্ষেপের পাশাপাশি আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে চলেছিলেন আরো কিছু নারী। তবে সেটা ভারতের অন্য কোনো ভূখণ্ডে। পশ্চিম ভারতের মতো জাতশুচিবাইয়ের অঞ্চলে পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের কথাও আমাদের জানা উচিত। নিজের কাজে তিনি বেগম রোকেয়ারই সমগোত্রীয় ছিলেন। তবে তাঁর পদক্ষেপ ছিল কিছুটা ভিন্ন।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেই ব্রিটিশ প্রশাসন নারী-শিক্ষার প্রসারে যত্নশীল হয়ে ওঠে। এ-জন্য তারা বিভিন্ন অনুদান ও বৃত্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এতে অন্তত স্বল্প পরিসরে হলেও নারী-শিক্ষার বিকাশ ঘটে। ফলে নারীদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষা-সম্পর্কিত সচেতনতা গড়ে উঠতে শুরু করে। পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু না। ১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল মারাঠিভাষী এক ব্রাহ্মণ-পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা অনন্ত ডোংরে ছিলেন সংস্কৃত-পণ্ডিত।  সম্ভবত, শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থেকেই ভারতীয় শাস্ত্র বিষয়ে বিশদ জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। তবে এই বিদ্যা অর্জনের যাত্রাটা সুখকর কিছুই ছিলো না।

আধুনিক সময়েও ভারতীয় দুর্ভিক্ষ এবং বিশেষত মড়ক লেগেই থাকত। ১৮৭৬-৭৮ মেয়াদকালে  মহারাষ্ট্রেই এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের দেখা দেয়। সেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে রমাবাঈ এবং তাঁর ভাই ডোংরে অনাথ হন। মা-বাবাকে হারিয়ে দুই ভাই-বোন সমগ্র ভারতে ভ্রমণ শুরু করেন। মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃত ও ভারতীয় শাস্ত্র সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করা।

এই জ্ঞান অর্জনের ফাঁকে তিনি কিছু কিছু স্থানে প্রভাষকের কাজও করতেন। প্রভাষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আস্তে আস্তে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কলকাতাতেও পণ্ডিত মহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এবার তিনি কলকাতাতে বক্তব্য রাখার নিমন্ত্রণ পান। ১৮৭৮ সালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর জ্ঞানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘পণ্ডিতা’ এবং ‘সরস্বতী’ উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করে।

এরই মধ্যে একেশ্বরবাদী সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেনের সাথে পরিচয় হয় রমাবাঈর। কেশবচন্দ্র তাঁকে বেদের অনুলিপি পড়তে দেন। এই সময় রমাবাঈ বেশ তর্কের সূচনা করেন। ১৮৮০ সালে তিনি বিপিন বিহারি মেধ্বি নামে এক বাঙালি কায়স্থকে বিয়ে করেন। স্বামী পেশায় আইনজীবী হলেও এই আন্তঃবর্ণ বিয়ে ভারতীয় সমাজ মেনে নিতে পারেনি। ১৮৮০ সালের ১৩ নভেম্বর এক নাগরিক অনুষ্ঠানে আয়োজিত এই বিয়ে যথেষ্ট তর্কের জন্ম দেয়। এই দম্পতির ঘর আলো করে মনোরমা নামের এক ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হয়। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই, অর্থাৎ ১৮৮২ সালে বিপিন বিহারি মেধ্বি মৃত্যুবরণ করেন।

২৩ বছর বয়সী বিধবা রমাবাঈ পুনে চলে আসেন। এখানে নারী-শিক্ষার প্রসারে তিনি আর্য মহিলা সমাজ গঠন করেন। স্থানীয় ভারতীয় সমাজ অবশ্যই এই কাজে মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। পরের বছর তিনি মেডিক্যাল ডিগ্রির জন্যে ব্রিটেনে চলে যান। কিন্তু মেডিক্যাল স্কুলে প্রত্যাখ্যাত হন। কারণ, রমাবাঈ বধির ছিলেন। ব্রিটেনে থাকা অবস্থায় তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। এবার একজন পূর্ণাঙ্গ সমাজসংস্কারক হিসেবেই রমাবাঈ ইতিহাসে নিজের নাম লিখিয়ে নেন।

নিজে হয়তো মেডিক্যাল-শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার আনন্দবাই যোশীর স্নাতকোত্তর অনুষ্ঠানে উৎসাহ দিতে ১৮৮৬ সালে আমেরিকায় যান। তবে তাঁর উদ্দেশ্য শুধু অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া না। সেখানেই তিনি পাঠ্যপুস্তকের অনুবাদ করতে শুরু করেন, যাতে নারী-শিক্ষা আরো সহজ হয়। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় বেশ কিছু বক্তৃতা প্রদান করেন। এখানেই তিনি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বই ‘দ্য হাই কাস্ট হিন্দু ওম্যান’ প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে। এই বইটির মাধ্যমেই তিনি ভারতীয় হিন্দু নারীদের অন্ধকার সময় এবং নিপীড়ন প্রতিরোধের চেষ্টা করেন।

১৮৯৬ সালেই মহারাষ্ট্রে আরেক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। নিজের অতীতের কথা তিনি কখনোই ভোলেননি। গরুর গাড়িতে চড়ে তিনি মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। এই সময় হাজার হাজার পরিত্যক্ত, অনাথ ও সর্বস্বান্ত নারীদের উদ্ধার করে সারদা সদন কিংবা মুক্তি মিশনে ঠাঁই করে দেন।

রমাবাঈ জ্ঞান ও সমাজসেবার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি সাতটি ভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। মারাঠিতে তিনি বাইবেল অনুবাদ করেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত জ্ঞান এবং নারী ও শিশু উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। ভারতীয় নারীর অগ্রগতিতে অবদান রাখায় ১৯৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর ভারত সরকার তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকেট চালু করে। এমনকি মুম্বাইতেও পণ্ডিতা রমাবাঈর নামে একটি ব্যস্ত সড়ক পাওয়া যাবে। রমাবাঈয়ের অনেক উদ্যোগ হয়তো রক্ষণশীলদের সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে তাঁর অবদানের প্রাবল্য আমরা নিজ চোখেই অবলোকন করতে পারছি।

  • আফরিদা ইফরাত

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ