ইতিহাসের পাতায় বিজয়ের গল্প
‘বিজয়’ শব্দটা শুনলেই মনে হয় এর সাথে জড়িয়ে আছে আনন্দ, সুখ, খুশী। কিন্তু বাংলাদেশ বিজয়ের সাথে জড়িয়ে আছে যুদ্ধ, ত্যাগ, সাহসিকতা, শোক, স্বাধীনতা। একদিনে আমাদের এই স্বাধীনতা আসেনি। এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীন দেশ। এই সময়টি ছিলো বাঙালি জাতির সংগ্রামের সময়, লড়াইয়ের সময়। ইতিহাসের পাতায় বিজয়ের গল্প স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ববাংলা) ছিলো পাকিস্তানের অন্তর্গত একটি প্রদেশ। প্রকৃতপক্ষে ’৪৭ এর দেশ ভাগের পর থেকেই পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের শিকার ছিলো পূর্ববাংলা। এই বৈষম্যতা, অবহেলা, অন্যায়, সাংস্কৃতিক আক্রমণ, অত্যাচার এসবের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।
এবং ফলাফল হচ্ছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। পাকিস্তার সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববাংলার সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতিতে আঘাত হানার চেষ্টা করে। তাই ২৫ বছরের সময়ের মধ্যে বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের। ’৫২ এ ভাষা আন্দোলন, ’৬২ এ শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ এ ছয় দফা দাবি, ’৬৯ এ গণঅভ্যূত্থান, ’৭১ এ অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে গিয়েছে বাঙালি। বাঙালির এসব আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি আসনের ১৬৭ টিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ’৭১ এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালিরা বুঝতে পারে এবার যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ নিরীহ, নিশস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাশবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে এক রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজারের মতো মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দেশের সব জায়গায় যেখানে সেখানে মানুষকে হত্যা করে পাকসেনারা। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। জীবন বাঁচাতে মানুষরা দেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় ভারতে। বাঙালিরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। নারী, পুরুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে থাকে। যুদ্ধের জন্য গরজে উঠতে থাকে বাঙালি।
এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সদরদপ্তরে একত্রিত হন। কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাহ উদ্দিন মোহাম্মদ রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফাত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ সেনা কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিতিতে চারজন সিনিয়র কমান্ডারকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়।
অন্যদিকে ১০ এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকার বা মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।
পুরো দেশকে মোট ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। কিন্তু অস্ত্রপ্রাপ্তি ও প্রশিক্ষণ ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পুরোপুরি শুরু হতে হতে জুন মাস পার হয়ে যায়। ১১ জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় ভারতে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তারা বিভিন্ন অপারেশনগুলো করতো।
মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি আরও অনেক বাহিনী সংগঠিত হয়। এ সকল বাহিনীর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনী, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা বাহিনী, ঝিনাইদহের আকবর হোসেন বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, বরিশালের কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী ও আফতাব বাহিনী অন্যতম।
এ সকল বাহিনী স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। ভারতের সেনাবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল ওবানের সহযোগিতায় মুজিব বাহিনী নামে আরেকটি বাহিনী গড়ে ওঠে। ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাল্যান্ডের দিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয় এবং যুদ্ধে অংশ নেয়।
পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা নৌসেনাদের ৯ নভেম্বর প্রথম নৌবহর ‘বঙ্গবন্ধু নৌবহর’ উদ্বোধন করা হয়। এভাবে ধীরে শক্ত হয়ে ওঠে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার দল। অন্যদিকে নভেম্বরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। যুদ্ধে যোগ দেয় মিত্রবাহিনী।
যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। তখন তারা বেছে নেয় একটি ঘৃণ্য পন্থা। তারা এই দেশকে মেধাশূণ্য করে দেয়ার পরিকল্পনা করে। দেশের সকল জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, গীতিকার, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ জ্ঞানী ব্যক্তিদের হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। আর তাদের সাহায্য করে দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী।
এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটা এক মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে শেষ হয় বাঙালির দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা ফিরে আসে স্বাধীন মাতৃভূমিতে।
৩০ লক্ষ প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি এই স্বাধীন বাংলা। লক্ষ মা হারিয়েছে তাদের ছেলেদের। পঙ্গু হয়ে গিয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের এই ত্যাগ কখনোই ভুলবার মতো নয়। তাঁদের অপার সাহস ও ত্যাগের জন্য আমরা আজ এই স্বাধীন দেশে বাস করছি।
তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ জ্ঞাপন করছি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ এখন আমাদের হাতে। তাঁদের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারবোনা, কিন্তু দেশের প্রতি সকল দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে দেশকে রক্ষা করতে পারবো। আমাদের উচিত তাঁদের দেয়া এই স্বাধীনতা রক্ষা করে চলা এবং এই সামনের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।