Skip to content

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণতন্ত্রের মানসপুত্রের জন্মবার্ষিকী আজ

বাংলাকে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে নেতা তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অবিভক্ত বাংলার  তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর ১২৯ তম জন্মবার্ষিকী আজ। বাংলাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ও অবিভক্ত বাংলার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা রোধে তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার ও সবার অগ্রগামী। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য খেটেছেন জেল, হয়েছেন পাকিস্তানের দুশমন; তবু মাথা নোয়াননি বরং বাংলার স্বাধিকারের জন্য ত্যাগের মহিমায় তিনি হয়েছেন ইতিহাসখ্যাত। 

 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর কনিষ্ঠ সন্তান। জাহিদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা বিচারক ছিলেন। মা ছিলেন নামকরা উর্দু সাহিত্যিক খুজাস্তা আখতার বানু। তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন কিন্তু সোহরাওয়ার্দি নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেন এবং বাংলার চর্চা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর যোগ দেন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি তাঁর মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

 

পারিবারিক বংশপরম্পরায় শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় কখনো কার্পণ্য ছিল না তাদের। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় সোহরাওয়ার্দীই প্রথম ‘ডক্টরেট’। ইউরোপ থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ‘ঠাকুর অধ্যাপক’ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি দেয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় স্বরাজপার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯২৩ এর বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে তাঁর ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তিনি জড়িত হননি। 

 

১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৬ এর শেষের দিকে এই দলটি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাথে একীভূত হয়। এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ তথা বিপিএমএল এর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে শ্যমা-হক মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পরে গঠিত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। বাংলায় সোহ্‌রাওয়ার্দীর প্ররোচনায় এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। আর এভাবেই উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির পিছনে সোহরাওয়ার্দী কখনো সরবে ও কখনো নীরবে কাজ করে গেছেন।

  
১৯৪৭ এর আগস্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরে মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর বাংলার স্বাধিকারের পক্ষে কথা বলায় ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনার জন্য বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে “ভারতীয় এজেন্ট” এবং “পাকিস্তানের শত্রু” হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়। তাঁর অনুসারীরা অনেকে ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং ১৯৪৯ এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। 

 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু’বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

 

১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এই যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল- লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বে সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয় লাভ করেন। মুসলিম লীগ সম্পূর্ণভাবে পরাভূত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে ১১ই অক্টোবর ১৯৫৭ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পররাষ্ট্র বিষয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে  তাঁকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়।

 

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে সোহরাওয়ার্দী পদক্ষেপ নেন। তার জন্যই তিনি পাকিস্তানের চক্ষুশূলে পরিণত হোন। ১৯৫৯ সালে ইলেক্টিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশান অর্ডারের নীতি দেখিয়ে চক্রান্ত করে তাঁকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাঁকে ১৯৬২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিপক্ষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার রেখেছেন এবং ১৯৬২ সালে আয়ুববিরোধী আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। 

 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন অনাচার, অনিয়ম অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সবসময়ই বাংলার মেহনতি মানুষের পক্ষে ছিলেন। চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের সুপ্রতিষ্ঠা। বাংলার মানুষ তাই ভালোবেসে তাঁকে গণতন্ত্রের মানসপুত্র নাম দিয়েছিল। বাংলা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান যাদের অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে ছিলেন সরব ও উজ্জ্বল, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী, সুপরিচিত ও কিংবদন্তি রাজনৈতিক ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ঐতিহাসিক স্থানকে স্বাধীনতার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হিসেবে নামকরণ করে বাংলার প্রতি তাঁর অসামান্য অবদানকে সম্মান করা হয়। ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর লেবাননে নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান এই মহান নেতা, তবে বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে স্মরণ করে বাঙালির গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে তাঁকে স্মরণ করে।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ