‘আমার শিক্ষার্থীরা প্রাথমিকে শ্রেষ্ঠ হবে, এটাই আমার অনুপ্রেরণা’
অনন্যা: মুজিববর্ষে দেশ সেরা শিক্ষিকা সম্মানে ভূষিত হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন।
ফাতেমা: ধন্যবাদ।
অনন্যা: আপনার কাছে প্রাপ্তির অনুভূতি কি?
ফাতেমা: আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও ধন্য। এই আনন্দ আমার একার নয়। এই আনন্দ আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের, যারা নানা উদ্যোগে আমার সাথে কাজ করেছেন, আমাকে সহায়তা করেছেন। আমি একা কাজ করবো এটা যারা অনুভব করতে দেননি তাদের সবার। আমার এ আনন্দে সবার অংশীদারিত্ব রয়েছে।
অনন্যা: শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার পেছনে আপনার কোন কাজের অবদান বেশী বলে মনে করেন?
ফাতেমা: প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আমার ছাত্রছাত্রীদের সাফল্য তথা বিদ্যালয়ের সাফল্যই আমাকে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত করেছে। আমি কখনো সাফল্যের জন্য কিছু করিনি। আমি করেছি আমার অবস্থান থেকে দেশকে সেরাটা দিতে। এর জন্য অনেকগুলো কাজই অবদান রেখেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্চে- দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন সকালে ও রাতে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছি। কেননা তাদের অনেকেই কর্মসময়গুলোতে বিদ্যালয়ে আসতে পারতো না। এর জন্য আমি ফান্ড গঠন করেছিলাম। সেখান থেকে খাতা, কলম, স্কুলড্রেস, চার্জার লাইট, চশমাসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে তাদের ঝরে পড়া রোধ করেছি। ফলে সেখান থেকেও অনেক মেধাবী মুখ বেরিয়ে এসেছে।পঞ্চম শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলের জন্য রাতে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছি।
এর বাইরেও স্থানীয়দের সহায়তায় কিছু কাজ করেছিলাম। বিদ্যালয় এবং তার আশেপাশের এলাকায় ৬টি সিসি ক্যামেরা, একটি বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন স্থাপন, শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষারত মায়েদের জন্য কল্যাণী পাঠকেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছি। ছাত্রছাত্রীদের হাতের লেখা ভালো করার জন্য মায়েদের লেখা শেখানোর ব্যবস্থা করেছি। আমি চেয়েছিলাম আমার ছাত্রদের শতভাগ পঠন দক্ষতা অর্জন করাতে। এ লক্ষ্য পূরণ করতে পড়ুয়া মঞ্চ স্থাপন করেছি। ওই পড়ুয়া মঞ্চে ভাষা ও সাংস্কৃতিক ক্লাবের বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হতো, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, এসআরএম ও পাঠ্যবই থেকে শিক্ষার্থীরা নাটক মঞ্চস্থ করতো।
অনন্যা: করোনাকালীন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় বাসায় অবস্থানের কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশে সমস্যা তৈরী হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য আমরা পাচ্ছি। এসময়কালে আপনার শিশুদের জন্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ফাতেমা: করোনাকালীন সময়ে আমার বিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সফলতা শতভাগ ছাত্রছাত্রীই বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আনন্দের সাথে পড়াশোনা করছে। এই জন্য আমি আমার ছাত্রছাত্রী অনুপাতে শিক্ষকগণকে বন্টন করে দিয়েছি। বন্টন অনুযায়ী শ্রেণিশিক্ষক প্রতি শুক্রবারে ৭ দিনের পড়া মেসেজ করে দেন। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত কি করছে তার খোঁজ-খবর নেই আমি।
অনন্যা: শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে জোর দেয়া হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ। নৈতিক শিক্ষার অবস্থান আপনার শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু সমুন্নত?
ফাতেমা: মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার অনুশীলনের কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে। আমি চেষ্টা করেছি আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার প্রচলন শুরু করতে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আমি প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়ে সততার দোকান, মানবতার দেয়াল, প্রতিদিন সমাবেশে সামাজিক ব্যাধিকে না বলা, বিদ্যালয় প্রদত্ত ডায়েরীতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করে ডায়েরীতে লিখে এবং পরদিন শ্রেণিশক্ষককে দেখানো, অনুসরনীয় মহান ব্যাক্তিবর্গের ভালো কাজের ভিডিও দেখে বা ছবি দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করার ব্যবস্থা করেছি। আমি বাচ্চাদের বলে দিয়েছি, বাড়িতে থেকে নিয়মিত পড়ালেখা করা, পিতামাতা, গুরুজন ও শিক্ষকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। আমি আমার উদ্ভাবনী, আন্তরিকতা ও কর্মদক্ষতা দিয়ে আমার টীমকে সাথে নিয়ে আমার বিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।
অনন্যা: প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও আপনি অসংখ্যবার বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কি ছিল?
ফাতেমা: প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি সবসময় স্বপ্ন দেখেছি আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক শিক্ষার সকল ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। আর আমার এই স্বপ্নই ছিল আমার অনুপ্রেরণা।
অনন্যা: করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষক হিসেবে সারাদেশের শিক্ষকদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
ফাতেমা: করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সকল শিক্ষককে নিজ নিজ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। কাজ করতে হবে আন্তরিকতা ও নিবেদিত হয়ে। আমি কখনোই দেশসেরা হবো ভেবে কাজ করিনি। আমি সবসময়ই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আন্তরিক ও নিবেদিত হয়ে কাজ করলে সফলতা আসবেই।
অনন্যা: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফাতেমা: আপনাকেও ধন্যবাদ।