‘সাহিত্যের ভাষায় সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল উঠুক, আমরা তা চাই না’
[ভাষার কাজ হল যোগাযোগ স্থাপন করা। মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করা। তবে ভুলে গেলে চলবে না, ভাষা হল সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ। মানুষের সামাজিক দীক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাত সব কিছুই ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। সম্প্রতি সিএনএন এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক জরিপে দেখা যায়, এক হাজার আমেরিকানদের মাঝে ৬৫% চান দেশটির ভাষা শুধুমাত্র ইংরেজি হোক। অন্য কোনো ভাষাভাষীরা যাতে তাদের নিজেদের ভাষা চর্চা করতে না পারে এবং নিজের সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পরতে না পরে সেই জন্যে পড়াশুনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিবাকরি সর্বত্র ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করার প্রতি তাদের রায়। মার্কিন ভাষা বিজ্ঞানী রবার্ট ডোল মনে করেন, "We must stop the practice of multilingual education as a means of instilling ethnic pride or as a therapy for low self-esteem" (Hornblower, 1995)। বিষয়টা সত্যি ভাবায়। তাহলে কি সাহিত্যের ভাষাতেও সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল উঠতে বাধ্য?
নিউইয়র্কের মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলায় অংশগ্রহণ করেন বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। মুক্তধারার দপ্তরে এই জনপ্রিয় লেখকের মুখোমুখি হওয়া এবং সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়। ভাষায় সাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে আমাদের সেদিনের আড্ডাটি জমে উঠেছিল। পাশাপাশি সাহিত্যের ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা, আমেরিকায় নতুন বাঙালি প্রজন্মদের আত্মায় বাংলা সাহিত্য ভাবনা, সাহিত্যের ভাষা, ঢাকা-কলকাতায় সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে।]
আদনান সৈয়দ: ঢাকা-কলকাতা থেকে নিউইয়র্ক তো অনেক দূরে, নিউইয়র্কের মতো এই ভিনদেশি জলবায়ুতে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের চর্চা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
সমরেশ মজুমদার: নিউইয়র্কে এলে আমার কখনই মনে হয় না যে আমি বাংলা থেকে অনেক দূরে আছি। যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই আমাদের সাহিত্য আছে, ভাষা আছে। শুনেছি এই নিউইয়র্কেও অনেক বাংলা শেখার স্কুল হয়েছে। এসব স্কুলগুলোতে আমাদের নতুন প্রজন্মরা বাংলা শিখবে এবং বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে আমাদের সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করবে, এমন আশা আমরা করতেই পারি।
আদনান সৈয়দ: কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, আমেরিকায় বাঙালি নতুন প্রজন্মদের কাছে আমাদের ভাষা, সাহিত্য কতটুকু জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছে সেটাও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: একদম ঠিক কথা। সত্যি বলতে কি আমি এ অভিযোগ অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছি যে এখানকার নতুন বাঙালি প্রজন্ম বাংলা সাহিত্য তো দূরের কথা বাংলাও ঠিকভাবে পড়তে পারে না। অবশ্য এদের ভেতর ব্যতিক্রমও আছে। এখানে অনেক বাংলা স্কুল এবং সংগঠন আছে যাঁরা বাংলা শেখানোর ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তবে পুরো বিষয়টা নিয়ে আমি আশাবাদী। যে শহরে এত বড় একটা বইমেলা হচ্ছে সেই শহরের মানুষ বাংলা শিখবে না, বাংলাকে লালন করবে না তা হতে পারে না। তবে এ কথাও আমাদের মানতে হবে যে আমেরিকায় যে বাঙালি শিশুটির জন্ম হচ্ছে তারা কিন্তু আমাদের মত বাঙালি নয়। তারা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য পড়বে, কথা বলবে সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। আমরা এর জন্যে খুব জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না। বরং উল্টো আমরা যে কাজটি করতে পারি তা হল আমরা আমাদের ভাষায় রচিত সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাদের সামনে রাখতে পারি। এখন নিউইয়র্কে বাঙালি প্রজন্ম যদি বাংলা না শিখতে পারে বা পড়তে পারে সে জন্যে শুধু তাদের দায়ী করলে চলবে না। আর তাদেরকে দায়ি করবো কোন সাহসে? বাংলাদেশ বলুন আর পশ্চিমবঙ্গ বলুন, সবখানেই ইংরেজি মিডিয়ামের করতলগত হয়ে গেছে। চারদিকে কোথায় যেন একটা দীনতা দেখতে পাই।
আদনান সৈয়দ: তাহলে এই দীনতার জন্য দায়ী কে?
সমরেশ মজুমদার: আমরা যারা অভিভাবক আছি আমরা সবাই এর জন্য কম-বেশি দায়ী। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতির খবরটাতো নতুন প্রজন্মদের কাছে আমাদেরকেই দিতে হবে। বেশ বুঝতে পারি যে ভাষার সাথে সামাজিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য নাড়ির টান রয়েছে। এ দেশে যে শিশুটি বড় হচ্ছে সেতো এখানে ইংরেজি সাহিত্য পড়ে বড় হচ্ছে। সে এই দেশের রীতি-নীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিকে ধারণ করে বড় হচ্ছে। এবং তারা ইংরেজি সংস্কৃতিকে বুকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে উঠবে এই স্বাভাবিক। সে কারণে বাংলা তার জন্যে গৌণ একটি ভাষা। সেদিক দিয়ে ভাবলে শুধুমাত্র অভিভাবকরাই পারেন তাদের সন্তানদের আত্মায় নিজ ভাষার সুধাটি তুলে দিতে।
আদনান সৈয়দ: মানছি আপনার কথা। এখানে যে শিশুটি বেড়ে উঠছে সে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলার চেয়ে ইংরেজির দিকেই বেশি ঝুঁকবে। কারণ ইংরেজি হল তার মাতৃভাষা। কিন্তু এই বাস্তবতাটা যদি মেনে নিই তাহলে কিন্তু আমাদের এখানকার নতুন প্রজন্মরা বাংলা শিখছে কী শিখছে না এই বিতর্কে যাওয়া আমাদের একেবারেই উচিৎ না। তাই নয় কী?
সমরেশ মজুমদার: আজকাল বাংলাদেশ, ইন্ডিয়াতেও আমাদের ছেলেপেলেদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে মানুষ করা হচ্ছে। এরা অনেকেই আমাদের সাহিত্যের খবর রাখে না বা রাখার আগ্রহবোধ করে না। আমি মনে করি, বিষয়টা গভীর থেকে ভাবার সময় এসেছে। নতুন প্রজন্মের বাঙালি সে বাংলাদেশ হোক, পশ্চিমবঙ্গ হোক, নিউইয়র্ক হোক আর পৃথিবীর যে কোনো দেশে বাস করুন, তাদের জন্যে আমাদের কাজ করতে হবে। সব দায়িত্ব শুধু তাদের ঘাড়ে ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের প্রচুর অনুবাদ সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়তে হবে। আমাদের জনপ্রিয় বাংলা সাহিত্য আমরা ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারি আর সেই সঙ্গে সাহিত্যের প্রতি তাদের আগ্রহবোধটাকে জাগিয়ে তুলতে পারি।
আদনান সৈয়দ: তাহলে সমস্যার কিন্তু কোনো সমাধান হল না। ইংরেজিতে অনুবাদের কারণে তারা আরো বেশি বাংলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
সমরেশ মজুমদার: তা ঠিক। কিন্তু এতো হবে মন্দের ভালো। অন্তত অনুবাদের মাধ্যমে তারা আমাদের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। তাই না?
আদনান সৈয়দ: অন্য প্রসঙ্গে আসি। সাহিত্যের ভাষা কেমন হওয়া উচিত এ নিয়ে বেশ হৈচৈ শোনা যায়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
সমরেশ মজুমদার: আসলে সাহিত্য তো একটি শিল্প যার অনেকটুকু জুড়েই রয়েছে ভাষার বুনন। তাই ভাষার প্রায়োগিক দিকটি সাহিত্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আদনান সৈয়দ: তাহলে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষায় সাহিত্য হতে দোষ কি?
সমরেশ মজুমদার: চরিত্রের প্রয়োজনে সেরকম ভাবে ভাষার ব্যবহার হতেই পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনে কথ্য ভাষার ব্যবহার আমি সমর্থন করি না।
আদনান সৈয়দ: আপনি হয়ত জানেন যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চিলেকোঠার সেপাই, খোয়াবনামায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। তাতে কিন্তু তাঁর উপন্যাসের মান কমে নি। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের কিছু নাটক জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল শুধুমাত্র কথ্যভাষার প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন বলেই।
সমরেশ মজুমদার: এ বিষয়ে আমি দ্বিমত করছি না। এখানে পাঠক বা দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাই আসল কথা। আমি শুধু বলতে চাইছি যে, সাহিত্যের নিজস্ব একটা সুন্দরতম প্রকাশের ক্ষেত্র থাকে যেখানে ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন ধরুন আমি বাংলাদেশের পাঠকদের কথা ভেবে ‘ডানায় রোদের গন্ধ’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম। অবাক ব্যাপার যে বাংলাদেশের পাঠকরা তা গ্রহণ করেননি। বিষয়টা আমাকে খুবই বিস্মিত করেছে।
আদনান সৈয়দ: এমনকি হতে পারে না যে ‘ডানায় রোদের গন্ধ’ উপন্যাসে পাঠকরা তাদের চিরচেনা সমরেশকে খুঁজে পায় নি?
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই হতে পারে (হেসে হেসে)। সেটাও সম্ভব। তো সে কারণেই বলি শুধু শুধু আঞ্চলিক শব্দ সাহিত্যে জুড়ে দিলেই চলবে না। পাঠকদের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতাও থাকা চাই।
আদনান সৈয়দ: পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। আপনাদের লেখা বাংলাদেশের মানুষের মুখেমুখে। কিন্তু অবাক ব্যাপার যে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের বই কলকাতায় খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। অবশ্যই দুই একজন বাদে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
সমরেশ মজুমদার: আমি কিন্তু এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে একমত নই। পশ্চিমবঙ্গেও বাংলাদেশের বই অনেক চলে। তবে এখানে দুটো বিষয় কাজ করছে। প্রথম কথা হল বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের যেমন ছড়াছড়ি আমাদের কলকাতায় কিন্তু বাংলাদেশের বই সেভাবে আসছে না। আর দ্বিতীয় কারণটা একটু অন্যরকম। হতে পারে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা এখনও খুব বেশি পরিমাণে রক্ষণশীল। তারা যাদের বই পড়ে অভ্যস্ত শুধু তাদের বই পড়তে চান। তারা বাংলাদেশের বইয়ের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের দিকেই বেশি তাকিয়ে থাকেন।
আদনান সৈয়দ: তাহলে বৈষম্য একটা আছে?
সমরেশ মজুমদার: এটা কোনো বৈষম্য নয়। সব ভাষারই একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এখানে বৈষম্যের চেয়ে বলব এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে এর পরিবর্তনও ধীরে ধীরে আসছে। কারণ আপনি জানেন যে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আত্মায় পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবন, তাদের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি আলাদা একটি ভালোবাসা রয়েছে। আমাদের অনেক লেখক রাজনীতিবিদ, বড় চলচ্চিত্রকার তারা সবাই মূলত ছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষ। তাই সেদিক থেকে ভাবলে আমি বিষয়টাকে বৈষম্যের পরিবর্তে ‘অনভ্যস্ততা’কেই দায়ী করবো।
আদনান সৈয়দ: বর্তমানে উগ্র মৌলবাদীদের উত্থান বেড়েছে। ধর্মকে পূঁজি করে অনেক রাজনীতিবিদ ঘোলা জলে মাছ শিকারে ব্যস্ত। বাংলাদেশ বলুন আর ভারত বলুন সবখানেই এদের দাম্ভিক বিচরণ রীতিমত ভাবিয়ে তোলে। আপনার কি মনে হয় সাহিত্যেও এর প্রভাব ফেলবে?
সমরেশ মজুমদার: সাহিত্য যেহেতু সময়কে ধারণ করে তাই এর কিছু আঁচর সাহিত্যে পড়তে বাধ্য। যেমন ইদানিং লক্ষ্য করছিলাম বাংলাদেশে কেউ কেউ তাদের লেখায় মূল্য কে হাদিয়া অথবা দোকানকে মোকাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাতে করে আমার মনে হয় আমাদের সাহিত্যের ভাষায় ধীরে ধীরে একটা সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল উঠছে। আমরা কিন্তু এটা চাই না।
আদনান সৈয়দ: বাংলার সঙ্গে আরবির মিশ্রণতো সেই অনেক আগে থেকেই। আরবি শব্দের ব্যবহার মানেই কি সাম্প্রদায়িকতা?
সমরেশ মজুমদার: না তা কেন হবে? আমি বলছিলাম কেউ যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এর ব্যবহার করতে চায় তাদের কথা। তবে আশার কথা হল আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যারা তারা এ বিষয়গুলোকে তেমন একটা আমল দেয় না। এই কিছুদিন আগে আমি বাংলাদেশে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বন্ধুটি তার বাবার কুলখানিতে মিলাদ পড়াবে এবং গরীবদেরকে খাওয়াবে, সে কারণেই যাওয়া। মসজিদে সবাই কুলখানিতে অংশগ্রহণ করেছে। আমার সঙ্গে টুপি থাকার কথা নয়। তবে পকেটে রুমাল ছিল। আমিও মাথায় রুমাল বেঁধে বন্ধুটির সঙ্গে মসজিদে কুলখানিতে অংশ নিই। অবাক বিষয় আমার কখনো মনে হয়নি আমি হিন্দু আর তারা মুসলমান। অথবা তারা আমাকে হিন্দু বলে আলাদা করেননি। বরং বিপরীতভাবে আমি এসেছি শুনে চারদিকে আমাকে দেখার জন্য লোকেলোকারণ্য। খুব ভালো লাগছিল দৃশ্যটা দেখে। তখন মনে আস্থা জাগে। ভাষায় সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল উঠবে না, আমাদের পাঠকরাই তা হতে দিবে না। এটাই আমার বিশ্বাস।
আদনান সৈয়দ: সমরেশদা, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্যে। আপনার সুস্থতা কামনা করছি।
সমরেশ মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।