নিপীড়নের বিচার চান মাত্র ১.১ শতাংশ নারী!
সামাজিক সংস্কার ও সংস্কৃ তির সংকট আগেও ছিল। তবে বিচার- প্রক্রিয়াও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ নয় বলে নির্যাতনের শিকার নারীরা আইনের শরণাপন্ন হতে আগ্রহী হতে পারেন না। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক আইন রয়েছে এবং সে আইনও বেশ শক্তপোক্ত। কিন্তু আইনের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অনাগ্রহ ব্যাপক আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না এমন অভিযোগ অনেকের।
পারিবারিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পুলিশ, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও গ্রাম্য সালিশে বিচার দাবি করেন। পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা চান বা মামলা করেন মাত্র ১ সশমিক ১ শতাংশ নারী।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে উদ্বেগজনক এই তথ্য উঠে আসে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের মূল কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশি সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা’ শিরোনামের সেমিনারে উপস্থিত বক্তারা জানান, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রথমে সমাজে সুপ্ত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তাছাড়া বিচারপ্রক্রিয়া স্বাচ্ছ করার জন্য যেকোনো অভিযোগের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত দ্রুত করা, অভিযোগ খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, মেডিকেল প্রতিবেদন ও ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত করা, সাক্ষী আনা এবং বিচার কার্যক্রম দ্রুত করা জরুরি। আইন প্রক্রিয়া যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সেজন্য সাক্ষী ও ভূক্তভোগীকেও সুরক্ষা দিতে হবে। জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুলিশের জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি নারীবান্ধব পুলিশ গঠনে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
সেমিনারটিতে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বিভিন্ন সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা নিয়ে তার করা গবেষণায় তথ্য তুলে ধরে বক্তব্যে বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীদের ২ দশমিক ৬ শতাংশ পুলিশ, এনজিও ও সালিশে বিচার চাইছেন। আর ১ শতাংশের কিছু বেশি অংশ পুলিশের কাছে মামলা করেন। বিচারপ্রক্রিয়ার শিখিলতার পাশাপাশি যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ না হওয়ায় বিচার দাবি করেও ন্যায্যবিচার পাচ্ছেন না। ধর্ষণের ক্ষেত্রেই রায়ের হার মাত্র ১ শতাংশ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে সংকটের নিষ্পত্তি করা সহজ নয়। ন্যায়বিচার পাওয়ার পর ক্ষতিপূরণের বিষয়েও সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে রাষ্ট্রতরফের তোরজোর জরুরি।
সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম তার বক্তব্যে বলেন, ‘নারী নির্যাতনের মামলা লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করায় দীর্ঘসূত্রতা বাড়তে শুরু করেছে। দেশে ডিএনএ ল্যাব অনেক কম। এমন ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা করেও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অনেকে।’ ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারগুলোর (ওসিসি) মামলা করা থেকে শুরু করে সব সেবা যেন একা জায়গায় পাওয়া যায় এ বিষয়টিতে তিনি জোর দিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রোধেও বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে তাগাদা দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহকারী পরিচালক তাপসী রাবেয়াও তার বক্তৃতায় বলেন, ‘অপরাধ যেখানেই ঘটুক না কেন ভুক্তভোগী বিচার দানি করার জন্য যেকোনো অবস্থান থেকেই আবেদন করতে পারেন।
উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। ফলে অনেকেই এখনো খানার আওতাভুক্ত এলাকা না হলে মামলা নিতে চান না। এ সম্পর্কে আরো সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানান তিনি।
সভায় পুলিশের দুজন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মামলার পর মেডিকেল, ফয়েনসিক ও ডিএনএ প্রতিবেদন পেতেই কয়েক মাস চলে যায়। এ কারণে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতেও দেরি হয়।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত এসিসির সমন্বয়কারী চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমীন জানান, পুলিশকে মেডিকেল প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেওয়া হয় না। কোনো কারণে প্রতিবেদন গেতে দেরি হলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছেন। ওসিসিতে ভুক্তভোগী এলে পুলিশকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এ ব্যাপারেও তিনি তার সমর্থন জানিয়েছেন। এর আগে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার নামে নারী ও শিশুদের সহায়তা দেওয়া শুরু হয়। ওসিসি স্থাপনের পর থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬টি মামলা করা হয়েছে। পারিবারিক বিরোধ নিয়ে অভিযোগ এসেছে ২ হাজার ৬০৪টি।
সভাপতির বক্তব্যে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, ঢাকার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) হুমায়রা পারভীন জানান, ‘নারী ও শিশুদের সহায়তায় পুলিশের সদিচ্ছার অভাব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী মামলা করতে দেরি করেন। এই দেরি করতে গিয়ে আলামত সংরক্ষণ করতে পারেন না। এই দেরি করায় মামলার তদন্ত অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়।’ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মতামত নিয়ে তারা তাদের সেবার মানকে আরো বাড়াতে চান। সেমিনারটিতে আরো অনেকেই বক্তৃতা দিয়েছেন। ন। নারীর নির্যাতনের হার নিয়ে উদ্বেগের সময়ে সচেতনতামূলক এই সেমিনারটি অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।