মেনোপজ: নারীরা কতটা সচেতন?
সমাজের অতি রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা বা জানার ইচ্ছে থেকেও সবাই দূরে সরে থাকে। জীবনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কেও সচারাচর কাউকেই খোলামেলা আলোচনা করতে দেখা যায় না। এর ফলে হঠাৎ নারীদের শারীরিক সমস্যা ঘটলেও তারা লজ্জা, শঙ্কা নিয়ে কারোর কাছে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীদের জীবনে ঘটে পরিবর্তন। যেমন বয়ঃসন্ধিকালে (১১-১৪) ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হয়। ঠিক তেমনই বয়স যখন ৪৫-৫৫ এর মধ্যে তখন নারীদের জীবনে আবারও পরিবর্তন ঘটে। এবং দেখা দেয় নানাবিধ শারীরিক পরিবর্তন। কিন্তু নারীদের মধ্যে অতি সংকোচ, লজ্জা, শঙ্কার কারণে বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মাঝে কোন পূর্ব প্রস্তুতি দেখা যায় না। ফলে হঠাৎ শারীরিক পরিবর্তন মানিয়ে নিতে তাদের বেশ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের দেশে নারীরা মেনোপজ নিয়ে কতটা সচেতন?
ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়াকেই মূলত মেনোপজ বলে। বাংলা ভাষায় একে রজঃনিবৃত্তি বলে। অর্থাৎ নারীদের একটি বয়সের পর পুরোপুরি মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া। পৃথিবীর সব নারীকেই একটি বয়সে এসে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাসিক নিয়ে রয়েছে যেমন রাখঢাক তেমনই মেনোপজ নিয়েই রয়েছে লুকোচুরি! সাধারণত ৪৫-৫৫ বছর বয়সের মধ্যে নারীদের মেনোপজ হয়ে থাকে। বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির মতে, আমাদের দেশে নারীদের মেনোপজের গড় বয়স ৫১ বছর। এই সময়কালে মেনোপজের কারণে নারীদের শারীরিক বহু পরিবর্তন আসে। দীর্ঘ ১২ মাস অর্থাৎ ১ বছর যদি মাসিক বন্ধ থাকে তবে ডাক্তারি ভাষায় তাকে মেনোপজ বলা হয়। তবে মেনোপজের কয়েকটি ধরণ পরিলক্ষিত হয়। যথা : পেরিমেনোপজ, মেনোপজ এবং পোস্টমেনোপজ।
পেরিমেনোপজের সময় পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে যায়। এসময় পিরিয়ড ১-২ মাস পর পরও হতে পারে। এছাড়া ব্লিডিং অনেক বেশি বা অনেক কমে যেতে পারে। আর সম্পূর্ণ রূপে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়াকে মেনোপজ বলে। এবং মেনোপজ পরবর্তী অবস্থাকে পোস্ট-মেনোপজ বলে। যার ফলে নারীদের শারীরিক নানা পরিবর্তন ঘটে এসময়।
মেনোপজের ফলে প্রথমত নারীরা আর গর্ভধারণ করতে পারেন না। কারণ মাসিকের সঙ্গে গর্ভধারণ বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। আর শরীরে এস্ট্রোজেন নামক হরমোন কমে যাওয়ার ফলেই মেনোপজ ঘটে। যা নারীদের শরীরের খুবই উপকারী একটি হরমোন। এই হরমোন কমে যাওয়াতে নারীদের দৈহিক মিলনেও অনীহা দেখা দেয়। সৃষ্টি হয় নানা জটিলতাও। সব নারীর মেনোপজের একই লক্ষণ দেখা না গেলেও
মূলত সাধারণ লক্ষণগুলো হলো-
যৌন অনুভূতি বা ইচ্ছা না হওয়া, যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ না থাকা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া এবং মূত্রনালির সংক্রমণ (ইউটিআই), ঘুমের সমস্যা হওয়া, মাথাব্যথা, হঠাৎ গরম লাগা, রাতে ঘাম হওয়া, ত্বক, মুখ ও চোখ শুষ্ক হয়ে যাওয়া, কালশিটে বা কোমল স্তন, বুক ধড়ফড়ানি, পেশিভর হ্রাস, হাড়ের ভর হ্রাস ,গিরায় গিরায় ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়া, চুল পাতলা হওয়া, মুখ, ঘাড়, বুক ও পিঠের ওপরের অংশে চুল বৃদ্ধি পাওয়া, বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মেজাজি হয়ে যাওয়া, মনোনিবেশ করতে অসুবিধা, কিছু মনে না থাকা বা স্মৃতি সমস্যা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মেনোপজ বিষয়ে নারীদের অতি সংকোচের ফলে মেনোপজ নিয়ে তাদের মাঝে কোনই সচেতনতা দেখা যায় না। ফলে তারা জানেনও না হঠাৎ এ ধরনের সমস্যা বেড়ে যাওয়া মেনোপজের জন্য। শরীরে এস্ট্রোজেন হরমোন কমে গেলে নারীদের হাড় ক্ষয় রোগের সম্ভবনা দেখা দেয়। আর ৪৫ বছরের উর্ধ্বে নারীদের হাড় ক্ষয়ের জন্য এস্ট্রোজেন হরমোন দায়ী। এই হরমোন প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ নারীদের শরীরের ডিম্বানু উৎপাদনে এই হরমোন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ফলে মেনোপজের সঙ্গে নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতাও শেষ হয়ে যায়। এছাড়া হার্টের সমস্যাও বাড়তে থাকে।
এ সময় নারীদের শারীরিক পরিবর্তন ছাড়াও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। হঠাৎ শরীরে পরিবর্তনটা মনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। মুডসুয়িং ঘটে। মেজাজ খিটখিটে, অবসাদ, বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। তবে এই পরিস্থিতি নিয়ে নারীদের ভীত হওয়ার কোনই কারণ নেই। কারণ প্রত্যেক নারীকেই এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে না ঘাবড়ে শরীরের বাড়তি যত্ন নিতে হবে। পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, ওজন ঠিক রাখা, নিজেকে ঠান্ডা এবং আরামদায়ক স্থানে রাখা, সমস্যা হলে সংকোচবোধ না করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নারীদের আগে থেকেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যাতে পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে সমস্যা না হয়। এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ, হৃদপিণ্ডের সুস্থতার জন্যও ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।