Skip to content

১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লড়াকু এক নারীর গল্প

জীবন তো চলেই যায়। তবে জীবনের রুপপ্রবাহ সবার জন্যে ঠিক জীবনের মতো হয়ে ওঠেনা। অভাব, দারিদ্র বয়ে আনে হতাশা, আক্ষেপ। তবু সেই আক্ষেপ কিংবা হতাশাকে আঁকড়ে দুদণ্ড বিলাপের সুখটুকুও যেন অনেকের থাকেনা। নোয়াখালীর চর অঞ্চলে জন্ম নেয়া ফাতেমা বেগমের জীবন যেন তারই মূর্ত উদাহরণ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয়। জন্মের পর থেকেই জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ফাতেমা বেগমকে আমরা অনেকেই হয়ত বলবো জীবন সৈনিক। কিন্তু তাতে কি তার বাস্তবতা মুছে ফেলা যায়! 

 

সমাজে একজন নিম্নবিত্ত নারীকে যেসকল বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয় – তার ষোলকলাই যেন পূর্ণ হয়েছে ফাতেমা বেগমের। জন্মের পরেই শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার অপরাধেই হয়ত তার জীবনটা চরের বালিতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারত। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে সন্তান হবে। পরপর কয়েকবার ছেলে সন্তানের মুখ দেখার আশা করলেও ঘরে তার তিন মেয়ে। চতুর্থ মেয়ের জন্মের পর তিনি ভাবলেন ফাতেমাকে ফেলে আসবেন। সেটাই ছিল তার পরিকল্পনা। কিন্তু জীবনেরও কিছু পরিকল্পনা থাকে। সেই পরিকল্পনা ক্রুর ভাগ্যদেবের পরিহাস কিংবা খেলাচ্ছলেই হয়ত বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। তবে একে ঠিক বর্ণিল বলা যাবেনা। ফাতেমার দাদি বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে নিজের কাছেই নাতনীকে রাখেন। অতঃপর সাদামাটাভাবেই ফাতেমার বেড়ে ওঠা। 

 

নারীর যে স্বতন্ত্র সংসার সেখানে তিনি নির্যাতিত এবং একইসাথে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। ভাগ্যের ফেরে মাতৃত্বের স্বাদ হয়তো পেয়েছিলেন কিন্তু সেই যন্ত্রণার পরবর্তী সুখটুকুও যেন কেড়ে নেয়া হয়েছে। প্রথমে কাজ শুরু করেছিলেন গার্মেন্টস এ। পরিচয় হয় লাভলু মিয়া নামে এক রিকশাওয়ালার সাথে। দুজনের একটা ঘর ও বাধা হয়। কিন্তু সেটাও ছিল চাওয়ার সংসার। ফাতেমা অন্তঃসত্ত্বা হতেই লাভলু তাকে ছেড়ে আবার নতুন বিয়ে করে। ফাতেমা জানতে পারেন লাভলু এর আগেও ১৫ টি বিয়ে করেছে। ততদিনে জীবন আরেকবার ভেঙে পড়তে শুরু করে। 

 

ফাতেমার দাদিই তাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলো। এবার ফাতেমা প্যাডেলের রিক্সা চালাতে শুরু করে। সেই চাপ তার শরীরকে নিংড়ে নেয়। বলা বাহুল্য, ফাতেমা অসুস্থ হয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তি হন অন্তঃসত্ত্বা ফাতেমা। চিকিৎসার জন্যে এক লাখ টাকার মতো ঋণ তার কাঁধে জাঁকিয়ে বসেছে। ভাগ্য আরো কিছু লিখে রেখেছিলো। ফাতেমার একটি ছেলে সন্তান হয়। কিন্তু তাও কিনা মৃত। এতদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে এই মূল্যটুকুই তাকে চুকাতে হয়েছিলো। যেন শরীর এই পারিশ্রমিক নিয়ে গিয়েছে। 

 

আর এখন নিজেকে টেনে চলেছেন। তাও কিনা রিক্সা চালিয়ে! ফাতেমার একটা জীবন এখনও ভারে জর্জরিত। সেও ঋণের ভার। দেনা পরিশোধের সংগ্রামেই জীবন তার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে একটুও সুখ নেই। সুখ মানে স্বস্তি। সেই স্বস্তিটুকুও তো দুদণ্ড শান্তি দিতে পারে। সকল অতীতকে ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করে।

 

জীবন তার নগরকেন্দ্রিক। এই নগরই কেড়ে নিয়েছে অনেককিছু। অন্তত গ্রামে গেলে টুকিটাকি কিছু করাই যায়। কিন্তু এখানে রয়েছে কি? বিষণ্ণ মেট্রোপলিস শুধু ক্রমশ হতাশা আর বিবর্ণতায় ঢেকে ফেলছে জীবন ফাতেমার। এতকিছু স্বত্বেও নিজের সততাকে ঠাঁই করে উপার্জন করে চলেছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন বাকি চল্লিশ হাজার টাকার ঋণ শোধের প্রচেষ্টা। 

 

এই পথটা এখনো সহজ নয়। শুধু নারী বলে উপার্জনের পথটাতেও শ্রমের চড়া মূল্যে জোগাতে হচ্ছে সীমিত কিছু বিবর্ণ টাকা। তবু এটাই নাকি তার একমাত্র পথ! তাই কি হয়! নারীরা নাকি স্বাবলম্বী! কিন্তু যেখানে পথই একটি – সেখানে অবলম্বন কোথায়। বরং এ তো ঠ্যাকার দায়ে পড়া। ফাতেমা এই ঠ্যাকার দায়ে থাকা নারীদেরই একজন। আমাদের এখনই এই অনুসন্ধান চালাতে হবে। নাহলে বুঝবো কিভাবে! নারীর জীবন কতটা ছড়িয়ে পড়েছে – কতগুলো পথ তাদের জন্যে শাখা – প্রশাখা বিস্তার করেছে?
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ