Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক মহিয়সী নারী সুফিয়া কামাল

গত শতকের বাংলার এক আশ্চর্য নাম সুফিয়া কামাল। জননী সাহসিকা দেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত কবি তিনি। প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের এ স্বপ্নদ্রষ্টার ১১১ তম জন্মদিন ছিল গতকাল ২০ জুন। 

 

সুফিয়া কামাল অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েও দেশমাতৃকা, গণমানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির সংকট নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবতেন। তার চিন্তা ও কর্মতৎপরতার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৩১ সালে তিনি মুসলিম নারীদের মধ্যে প্রথম নারী হিসেবে 'ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন'-এর সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম রোকেয়া ছিলেন তার সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যোগদানের অনুপ্রেরণা। তাই তো তিনি নিভৃতে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত 'আঞ্জুমান-ই- খাওয়াতিন' প্রতিষ্ঠানের হয়ে দীর্ঘদিন বস্তি এলাকায় ঘুরে ঘুরে মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার কাজ করে গেছেন। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে এবং '৪৬-এর 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'র সময়ে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গার পর বিপন্ন গণমানুষের সেবায়ও কাজ করেছেন।

 

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মহিলা পরিষদের সভানেত্রী। রাজপথে-জনপদে হেঁটে নারীমুক্তির মশাল প্রজ্বালনের পাশাপাশি দেশমাতৃকার মুক্তির গানও গেয়েছেন নির্ভীক কণ্ঠে। একাত্তরের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকায় নারী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে, ধানমন্ডির নিজ বাড়িতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে, পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর দান প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি তাঁর মুক্তিসংগ্রামী–সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা আবদুল কাহহার চৌধুরী শহীদ হন। তবু শোকে ভেঙ্গে পড়েননি তিনি।

 

মহান ভাষা আন্দোলনেও সুফিয়া কামাল সামনের সারি থেকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হলে সুফিয়া কামাল, মমতাজ বেগমসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সরকার রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি 'সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন' পরিচালনা করেন এবং এ সময়েই রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি এবং পল্লিগীতির ভালো শিল্পী তৈরির লক্ষ্য নিয়ে সংগীত বিদ্যায়তন ছায়ানটের প্রতিষ্ঠা করেন।

 

বাংলায় নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুফিয়া কামাল এক অনবদ্য নাম। কিন্তু আমাদের সমাজে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে এ রাষ্ট্র গঠনে সুফিয়া কামালের যে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবদান তা সম্পর্কে আমরা বর্ণাঢ্য আলোচনা দেখতে পাই না। বাংলায় গণমানুষের সামাজিক বঞ্চনা, সামাজিক অসাম্য বিশেষ করে নারী শিক্ষার অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, এমনকি আইনগত অধিকার নিয়ে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন তিনি।

 

১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে সুফিয়া কামালের জন্ম। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি দীর্ঘ কর্মজীবনে সুফিয়া কামাল মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন, নারীমুক্তির আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫৬ সালে ‘কচিকাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬১ সালে ছায়ানটের সভাপতি, ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি, ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠন ও ওই সময় অসহযোগ আন্দোলনে নারী সমাজের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তমসা-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিলে কবি সুফিয়া কামাল তা প্রত্যাখ্যান করেন। 

 

সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জীবিতকালে কবি সুফিয়া কামাল প্রায় ৫০টি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ