Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লক্ষ বাঙালির অশ্রুভেজা যশোর রোড

 

"Millions of souls nineteen seventy one

homeless on Jessore road under grey sun"

বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচিত কবিতা `সেপ্টম্বর অন যশোর রোড’ যা থেকে পরবর্তীতে গান করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব বিদেশীরা অবদান রেখেছিল তার মধ্যে অন্যতম একজন হলো অ্যালেন গিন্সবার্গ।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রোড নিয়ে তার লেখা এই কবিতাকে পরবর্তীতে সুর দিয়ে তিনি কনসার্টে গান করে শরনার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।

 

গিন্সবার্গ ছিলেন একজন যুদ্ধবিরোধী কবি। যুদ্ধ একটি দেশকে কিভাবে মেধাশূন্য করে সে বিষয়ে গিন্সবার্গ বলেন, ‘যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটি দেশ ভয়ংকর ভাবে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পর যে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠতে থাকে তারা অসুস্থ এবং উন্মাদ হয়ে যায় কারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা যুদ্ধ পরবর্তী মেধাবী প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়।’ পৃথিবীতে যখন যেখানেই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে  গিন্সবার্গ সব সময় তার প্রতিবাদ করেছেন। কখনো  রাজপথে নেমে, কখনো  কবিতায়, কখনো আবার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে।  

 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এগিয়ে এসেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় আসেন। কলকাতায় কিছু সাহিত্যকদের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো।  কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বেশি ভালো সম্পর্ক থাকায় তখন তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতেই উঠেছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছেই তিনি পূর্ব বাঙলার মানুষের উপর পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের কাহিনি  শুনেন। তারপর নিজের চোখে দেখার জন্য যুদ্ধের সময় বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন।আর তখন অসহায় বাঙালিদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাবার প্রধান পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড। প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয়ে যাবার জন্য এ পথটি ব্যবহার করেছিলো।

 

লক্ষ বাঙালির অশ্রুভেজা যশোর রোড

 

এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি রচনা করেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের বিখ্যাত কবিতাটি। এই সুদীর্ঘ কবিতাটিতে ভেসে উঠে বাঙলার বিধ্বস্ত রূপ, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেন। তবে চলুন নেয়া যাক যশোর রোড সম্পর্কিত কিছু তথ্য –

যশোর রোড  হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক।এই সড়কটি কলকাতার দমদম থেকে দেশের সীমান্ত শহর বনগাঁ এর ভারত- বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সড়ক পথটি প্রায় ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই মহাসড়কটির নাম বাংলাদেশের যশোর জেলা  বা যশোর এলাকার নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। কারণ এই মহাসড়কটি ঐতিহাসিক ভাবে কলকাতা থেকে যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ ভারতে যশোর শহরে একটি বায়ু সেনার বিমান ঘাটি ছিল। ফলে সেই সময় এই বিমানঘাটির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য যশোর রোড আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে যশোর রোড আলোচনায় আসে অ্যালেন্স গিন্সবার্গের 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড' কবিতার মাধ্যমেই।

 

লক্ষ বাঙালির অশ্রুভেজা যশোর রোড

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায় তিনি তুলে ধরেন ১৯৭১ এবং যশোর রোড। লাখো দুর্দশাগ্রস্ত শরনার্থীদের অবস্থা অবলোকন করে তিনি তুলে ধরেন তার কবিতায় –

‘শত শত মুখ হায় একাত্তর

যশোর রোড যে কত কথা বলে

এত মরা মুখ আধমরা পায়ে

 পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।’

 

নিউ ইয়র্কে ফিরে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেন। সেখানে অ্যালেন্স গিন্সবার্গের  কবিতা পাঠ সবার অন্তরকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় কবিতাটিতে সুর দিয়ে গানে রুপান্তরিত করেন। এক কনসার্টে তার গান গেয়ে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন । পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় শিল্পী মৌসুমি ভৌমিকের গলায় গানটি আরো জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

 

আর এভাবেই বাঙালির ইতিহাসের সাথে পুরো বিশ্বে পরিচিতি পায় যশোর রোড। এই যশোর রোড, লক্ষ লক্ষ বাঙালির অশ্রুভেজা রোড। এই রোড সন্তান হারা মাকে দেখেছে, স্বামীহারা স্ত্রীকে দেখেছে, তাদের চোখের জলে প্রতিনিয়ত স্নান করেছে, এই রোড সম্ভ্রমহারা নারীকে মুখ লুকিয়ে চলতে দেখেছে। শুধু তাই নয় এই যশোর রোড, লাখো শরনার্থীকে বিজয়ের মিছিল নিয়ে নিজ ভূখন্ডে ফিরতে দেখেছে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ