নারীকে দাসী বানিয়ে রেখো না
আমাদের সমাজে আজও ঘরের কাজ বলতেই বোঝানো হয় নারীর কাজ। কিন্তু একটি পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ই বসবাস করে। তাহলে ঘরের কাজ কেনো শুধু নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়? নারী তার মায়া- মমতা, ছায়াস্পর্শ দিয়ে পরিবারকে সংগঠিত করে রাখে কিন্তু তাই বলে সব কাজের বোঝা নারীর ওপর চাপানো উচিত নয়।
নারী-পুরুষ লিঙ্গ বৈষম্যের অন্যতম কারণ নারীকে অবরুদ্ধ রাখা ঠিক, তেমনই ঘরের কাজ বাইরের কাজকে বিভক্ত করে নারীকে আরেক ধাপ চাপে রাখা হয়েছে। যার মূল কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। একসময় ভারতবর্ষের শাসন ভার ছিল ব্রিটিশদের হাতে। নিজেদের ইচ্ছে মতো এদেশের মানুষকে শাসন করেছে, শোষণ করেছে। দেশের মানুষের উপার্জিত অর্থ, শস্য সবই তারাই ভোগদখল করেছে। ‘স্বর্ণ প্রসবিণী’ নামে খ্যাত এদেশের মানুষের ভাগ্য জুটেছিল দুঃখ-কষ্ট। না পাওয়ার যাতনা। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নিজেদের প্রভু ভেবে নারীর ওপর চাপিয়ে দেয় পাহাড়সম দায়িত্ব-কর্তব্য।
শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যের বোঝা দিয়ে নারীকে চাপে রেখেই এই শ্রেণি ক্ষান্ত থাকেন না বরং নারীকে কিভাবে শোষণ করা যাবে, তাদের প্রতি কতটা কদর্য রূপ প্রকাশ করলে নারীরা তাদের পথ থেকে ছিটকে পড়বেন সবকিছুরই পাঁয়তারা চলে পুরুষতন্ত্রের। নারীর জীবনকে কোনোভাবে সুখের হতে দেখলেই মুখে তাদের একটি কথাই শোনা যায়, ‘খুব তো শুয়ে-বসে দিন কাটছে। কাজ না থাকলে যা হয় আর কি।’ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই সাধারণ ধারণা আজ অবধি পরিবর্তিত হয়নি। কোনো নারী যদি বাড়ির বাইরে গিয়ে টাকা রোজগার না করেন, তবে গৃহস্থালির কাজকে কাজ হিসেবে গণ্যই করা হয় না। কিন্তু একজন নারী যিনি তথাকথিত গৃহিণী নামকরণের ছোট্ট পরিসরে আবদ্ধ তিনি সারাদিনে যত দায়িত্ব পালন করেন, হিসাব-নিকাশ করলে টাকার মূল্যমানে জিডিপির বড় একটা অংশ এখান থেকে আয় হতো। কিন্তু নারীর কাজের মূল্যায়ন করা হয় না।
এরপর আসে সেই ঘরের কাজ। যাকে শুধু আবদ্ধ করা হয়েছে কিছু মানসিক সীমাবদ্ধতা দিয়ে। বিষয়টি যখন ঘরের কাজ তখন একদৃষ্টে পুরুষতন্ত্রের মনে হয় এটি শুধু নারীর দায়িত্ব ও নারীরই কাজ। এই অন্দরমহলে পুরুষের আনাগোনা পুরুষ সমাজ মানতেই পারে না। এমনকি অনেক নারীও বিষয়টিকে সুদৃষ্টিতে দেখতে পারে না। পাশের বাড়ির ভাবির বাচ্চাকে যদি একদিন বাবা মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে বা একদিন রান্না-বান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজ করে, তাহলে ঘটে গুরুতর পাপ। পুরুষতন্ত্রের মতে শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের অন্নপাপে দুষ্ট হয়ে পড়েন এই ব্যক্তি। কিন্তু ঘরের কাজ কি নারীর একার?
ঘরের কাজ কখনোই নারীর একার নয়। কারণ সংসারটা কিন্তু নারীর একার নয়। বরং দুজনের গড়ে তোলা পবিত্র প্রতিষ্ঠান। যেই প্রতিষ্ঠানের মূলধন ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান এবং পারস্পরিক সহোযোগিতা। কিন্তু যখন এই বিষয়গুলোর একটির অনুপস্থিত ঘটে, তখন অন্য ব্যক্তি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে চাপে পড়ে। এই চাপই একসময় তার জীবনকে জটিল করে তোলে। কিন্তু পরিবার, সমাজের গোঁড়ামি, কুসংস্কার ভেঙে যদি একজন পুরুষ সহোযোগী হয়ে ওঠে, তবে নিশ্চিতভাবে পরিবারটির ভিন্নচিত্র পরিলক্ষিত হবে। যেখানে পারস্পরিক সহোযোগিতা, শ্রদ্ধাবোধ ও উভয়পক্ষের সমান অংশগ্রহণ থাকে সবকাজে, সেখানে অশনি সংকেত দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷
প্রথমত পুরুষতন্ত্রের এই ধরনের মানসিকতা গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে পরিবারগুলোই। কারণ পরিবার থেকে ভাগ করে দেওয়া হয় নারী এবং পুরুষের মধ্যে বিভেদ আছে। পুরুষ যে কাজটি করতে পারে, নারী তা পারে না। আবার নারীর কাজ পুরুষ তো কোনোভাবেই নজরেও আনবে না। যুগের পরিবর্তনে কিছু পুরুষের মধ্যে মানসিকতার যে একেবারে পরিবর্তন ঘটেনি, এমনটা বলা যাবে না। হলফ করে বলা যায় সেই পুরুষকে পারিবারিকভাবে নানারকম কটুকথার সম্মুখীন হতে হয়। তবে পরিবর্তন সবসময় ধীরগতির। ফলে যারা কিঞ্চিৎ পরিবর্তনকে এগিয়ে নিতে চান, তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ নয়। এটা চরম বাস্তব একটি কথা। কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে পড়ে থেকে বেশিরভাগ। এই বেশিরভাগের মানসিকতা কবে পরিবর্তন হবে? যৌক্তিক বিচারে কি তাদের মনে হয় না, ঘরের কাজ বলতেই নারীর কাজ নয়?
বরাবর একটি কথা খুব বেশি জোর দিয়ে বলতে চেষ্টা করি, সেটা পরিবার। কারণ পরিবার শিশুর শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরিবারে শিশু যে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটাকেই জীবনে ধারণ করে। ফলে প্রথম পদক্ষেপ পরিবারকে গ্রহণ করতে হবে। একটি ছেলে এবং একটি মেয়েসন্তান যদি একই পরিবারে থাকে তবে তাদের ভিন্নভাবে গড়ে না তুলে বরং সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। ভালো-মন্দের বিভেদ বোঝাতে হবে। ঘরের কাজ যে শুধু নারীর নয় বরং পরিবারে পুরুষ সদস্যদেরও সেই মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিই পারে পরিবারকে সুন্দর করে তুলতে। সর্বোপরি সমাজ তথা দেশকে সুগঠিত করতে। তাই আসুন ঘরের কাজ শুধু নারীর এই মানসিকতা পরিহার করি। গড়ে তুলি সুস্থ পরিবেশ যেখানে নারী-পুরুষ কেউই কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং সহোযোগী। আর এভাবেই সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই একে অন্যের প্রতি।
আর নারী- পুরুষ উভয়ই যদি একে অপরের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা – ভালোবাসা, সহোযোগিতা এবং সহর্মমিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তবে কোন কাজই নারীর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে না। পরিবারে নারীকে সম্মান দিলে, তার কাজের প্রতি সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধ- সম্মান বাড়ে বৈ কমে না। এবং নারীকে সম্মান তার কাজকে সম্মান করলে সাংসারিক নানা জটিলতাও কমে আসবে আশাকরি। তাই পুরুষের উচিত নারীর ওপর সব দায় চাপিয়ে না দিয়ে পরিবারের কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়া। নারীর একার সব দায় নয় পরিবারের সব সদস্যদেরই দায়িত্ব রয়েছে তাদের জায়গা থেকে যতটা পারা যায় কাজে অংশগ্রহণ করা। মানুষের বোধের উন্মোচন হোক। নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘুচুক। পুরুষতন্ত্রকে বলি, নারী দাসী নয়, পুরুষের সহযোগী। তাই তাকে দাসী বানিয়ে রেখো না। তাহলে নারীর যেমন সম্মান রক্ষা হবে, তেমনি পুরুষেরও উন্নতি হবে।