বুশরাকে নিয়ে মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা ও কিছু কথা
সম্প্রতি গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সংবাদ বেশ সাড়া ফেলেছে। জনমনেও বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়ার শেষ নেই । তবে সেখানে ইতিবাচক মন্তব্যের চেয়ে নেতির পরিমাণটাই বেশি। বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘চিফ হিট অফিসার’ নিযুক্ত হয়েছেন। তবে তিনি যতটা না তার কাজে কতটা আগ্রগামী হবেন, এ ব্যাপারে মানুষের কৌতুহল জাগছে তার চেয়ে তার ব্যক্তিক জীবন হরহামেশাই ফলাও করে দেখানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে শুধু সাধারণ মনুষই নয় বরং গণমাধ্যমগুলো আরও বাড়তি প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। দেশ- বিদেশের পত্রিকায় একইভাবে তাকে তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি কবে অভিনয় করেছেন, কার মেয়ে, কোথায় পড়েছেন, ব্যক্তিগত ছবি দিয়েও নানাভাবে হেনস্তা করার পাঁয়তারা চলছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন একের ভেতর সব, আবার কারও কারও মন্তব্য নিজেই উত্তাপ ছড়াতে এসেছেন, উত্তাপ কমাবেন কিভাবে! এরকম হীন-মানসিকতা প্রকাশিত হচ্ছে পুরো মিডিয়া পাড়াজুড়ে।
এখন কথা হলো নারীকে নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য আমাদের মানসিকতার কতটা পরিচয় বহন করে? এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে চোখে পড়লো একটি তথ্যসমৃদ্ধ- যুক্তিযুক্ত কলামের। লিখেছেন জান্নাতুল যূথী। তিনি বেশ গুছিয়ে বলতে চেয়েছেন, আমাদের সমাজে নারী মাত্রই কিভাবে কিছু কদর্য মানসিকতার মানুষের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন! যেখানে শুধু নারী হওয়ার কারণে বুশরা আফরিনকে কিভাবে দেখা হচ্ছে এবং তার পিতার পরিচিতি তাকে কতটা বিড়ম্বিত করেছে,তা নিয়ে সবিশেষ জাতির বিবেকের প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে।
জান্নাতুল যূথীর কলামে বুশরা আফরিনকে একজন মানুষ রূপে দেখা হয়েছে। কারণ নারী শুধু লিঙ্গজনিত কারণ হতে পারে, তার বেশি কিছু না। তবু আমাদের সমাজে আজ অবধি নারীকে দেখায় হয় ভোগ্য পণ্য হিসেবে। সত্যিকথা বলতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যতগুলো মন্তব্য আজ পর্যন্ত চোখে পড়েছে তার অধিকাংশই নারীটিকে হেনস্তা করে। নিজে নারী হিসেবে বিকৃত-কদর্য মানসিকতার এসব প্রকাশ সমানভাবে অপদস্ত করে। যূথী লিখেছেন, ‘একজন নারীকে অপমান মানে গোটা নারী জাতিকে অপমান করা। ঠিক তাই। বুশরা আফরিনকে এভাবে কাদা ছোড়া হলে সেটা যেকোনো নারীর গায়েই লাগা স্বাভাবিক। কারণ মন্তব্যগুলো অতি উৎকট। এখানে অনেকগুলো কথা থাকতেই পারে তাই বলে নারীকে বিভৎসভাবে উপস্থাপন করা উচিত নয়। এটা মানবিকতার অবক্ষয়। বিবেক- মনুষ্যত্বের মৃত্যু।’
বুশরা আফরিন নারী বলেই হয়তো তাকে নিয়ে এত কাদা ছোড়াছুড়ি। নাহলে সজাগ দৃষ্টি দিলেই বোধগম্য হবে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের তথা পাওয়ার-পজিশনঅলা ব্যক্তির সন্তানেরা তাদের স্থান অনুযায়ী তার সন্তানেরা অবস্থান গ্রহণ করেছেন । শুধু নেতা-নেত্রী বলা ভুল হবে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে যাদের ক্ষমতা আছে; এমন অধিকাংশ ব্যক্তিই তার সন্তানকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছেন। যোগ্যতা- ক্ষমতা থাকলে কে করেন না বা করেননি! মানুষের যোগ্যতা নিয়ে কথা বলা বোকামি, একইসঙ্গে হাস্যকর।
কিন্তু বুশরা আফরিনকে নিয়ে এত ট্রলের কারণ কী? তার ‘প্রধানত কারণ তিনি নারী এবং দ্বিতীয় কারণ তিনি ঢাকা উত্তরের মেয়র জনাব আতিকুল ইসলামের কন্যা।’ দুটি বিষয়ই খুব যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপন করেছেন জান্নাতুল যূথী। এরসঙ্গে আমি একটু যুক্ত করতে চাই, মূলত নারী হওয়ার কারণেই তিনি বেশি হেনস্তার শিকার হয়েছেন তারপর আবার তিনি হিট অফিসার নিযুক্ত হয়েছেন। ফলে কামুক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ‘হিট অফিসারকেই ব্যঙ্গ- বিদ্রূপ-নেতিবাচকতায় ভরিয়ে তুলেছেন। যা নারীর প্রতি অসম্মান-অশ্রদ্ধা প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়।
শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষই বিষয়টি নিয়ে নেতিবাচক কথায় বেশি বলছেন। যা আবারও প্রমাণ করে এ সমাজে যুক্তি ও মূল্যবোধের চর্চা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের সমাজ থেকে এ ধরনের মানসিকতা দূর করতে হলে নারীর প্রতি সম্মান গড়ে তুলতে হবে। আর তা একমাত্র সম্ভব পরিবার থেকে। অভিভাবকদ্বয় যখন যেকোনো নারী সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে কথা বলতে শিক্ষা দেবেন তখন ধীরে ধীরে ওই সন্তানের মধ্যে সেটাই গড়ে উঠবে। আমাদের নারীরা একটু ভালোভাবে বাঁচার স্বাধীনতা পাক।